মানুষ -- ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১০
সেদিন বিকালে জাকিরের দোকানের পাশে ওদের আড্ডায় হঠাৎ দৌড়ে এসে তাহি
বললো একটা গরম খবর আছে। দৌঁড়ে এসে তাহি হাপাচ্ছে। একটু পানি খেতে পারলে আত্মাটা
শান্তি পেতো। পানি আছে। সামনে এক সমুদ্র পানি। ঠান্ডা লাগলে দুপুরবেলা এই লবণপানি
যখন হালকা গরম থাকে তখন গড়গড়া পর্যন্তই ঠিক আছে। এই পানি আত্মা ভরে খাওয়া সম্ভব
না। সৃষ্টিকর্তা তার সব সৃষ্টির জন্য রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন। তাহলে ওদের ভাগটা
কই? কে ভোগ করছে?
তাহির হাপানো দেখে জাকির ওরে ডাক দেয়- ওই কুত্তার বাচ্চা, এদিকে
আয়, পানি খেয়ে যা। তোদের তো দুনিয়ায় আর জায়গা নেই আমার দুকান ছাড়া।
ইশি : দেখছিস বুড়া কয় কি? আমাদেরকে কুত্তারবাচ্চা বলে গালি দিছে।
টুকি : এখন কিছু বলিস না।
ইকি : তাহি তুই ভালোই ভালোই আগে পানি খা। পানি খেয়ে বুড়োটারে একটু
ভয় দেখিয়ে দিস। যেন সে বুঝতে পারে আমরা মাইন্ড করেছি।
জাকির আবারো ডাক দেয়- পানির লাইগা জিব্বা তো একহাত বাইর কইরা
ফেলছিস। এহনো গল্প মারাস কেন? কুত্তার বাচ্চারে ডাকছি শোনে না। ভাব মারাস? পানি
খেয়ে যা।
তাহি বাধ্যগত আচোরণ করে পানি খাইলো। ওদেরকে পানি দেবার জন্য
প্লাস্টিকের একটা গ্লাস রেখেছে জাকির। জাকির ওদের বকে, গালাগালি করে, তবে দিনশেষে
জাকিরই ওদেরকে বেশি ভালোবাসে, ওদের যতটুকু পারে খাওয়ায়। এটাই এই দ্বীপে অনেক বড়
কিছু। জাকির তাহিকে পানি খাওয়ায় আর বিড়বিড় করে বকতে থাকে। তাহিদের সাথে জাকিরের এই
বন্ধুত্ব ওর দোকানে আসা মানুষগুলোও বেশ উপভোগ করে। কারো দয়া হলে এক প্যাকেট
বিস্কুট কিনে খাওয়ায়। কখনো কখনো জাকিরই সিস্টেমে ওর কাস্টমারদেরকে ইমোশনাল
ব্লাকমেইল করে। জাকির পানি খাওয়ানো শেষ করতেই তাহি চিৎকার করে উঠলো। জাকির মারতে
গেলেই দৌঁড়ে পালালো তাহি। দোকানের কাস্টমারদের কাহিনীর সারমর্ম বোঝালো জাকির-
কুত্তার বাচ্চা বলেছি বলে মাইন্ড করেছিল। তবে প্রথমে রাগ দেখালে তো পানি দিতাম না।
তাই পানি খেয়েই রাগ দেখালো। এখন থেকে বাঘের বাচ্চা বলে ডাকবো। হাসতে হাসতে নিজের
কাঁধের গামছাতে চশমার ঘোলা কাঁচ মুছে আবারো নাকের উপর রাখলো জাকির। জাকির মানুষটা
রসিক আছে। সেই সাথে হিসেবি, দয়ালু, পরোপকারি। কাউকে উপকার করতে পকেট বড় হবার চেয়ে
আত্মা বড় হওয়া বেশি দরকার। ওরা পাঁচ বন্ধু সুযোগ পেলেই মানুষকে খুব গালাগালি করে।
তবে জাকিরের জন্য সব মানুষকে সমানে গালি দিতে পারে না ওরা। ওদের কাছে জাকির হলো এই
দ্বীপের সবচে ভালো মানুষ, সেরা মানুষ। শিক্ষা মানুষকে বড় করে না। শিক্ষা মানুষকে
স্বার্থপর করে, হিংসুটে করে, লোভী করে। জাকিরের মত সাদামাটা মানুষগুলো যদি এই
দ্বীপে আরো থাকতো, কতই না সুন্দর হত। মানুষের সাথে ওরা মিলেমিশে থাকতে
পারতো।
আচ্ছা, জিব্বা তো এবার ভেতরে ঢুকছে। এবার বল কাহিনী কি? তোর গরম
খবরটা কি? এখনো গরম আছে নাকি ঠান্ডা হয়ে গেছে? - বললো গুলু।
শুরু করলো তাহি- কাহিনী তো একটা ঘটে গেছে। শামুক বীচের ঘটনা। আজকে
বিকালে। কুচুরে রে বাইকয়ালা চাপা দিছিলো তারে ওখানে একা পাইছিল জুবু আর দিচু।
তারপর? - আগ্রহ নিয়ে সবাই একসাথে প্রশ্ন করলো তাহিকে।
শুরু করলো তাহি- ওরে থামানোর জন্য দিচু বাইকের সামনে লাফ দেয়।
সামান্য ব্যাথা পেয়েছে যদিও। তবে বাইকয়ালা বাইক নিয়ে বীচে পড়ে গেছে। তখনই জুবু ওর
পায়ে ৩ টা কামড় দিছে। আর দিচু হাতে একটা কামড় দিছে। ব্যাচ, কামড় দিয়েই দৌঁড়।
কেউ ওদের দেখেনি তো? - প্রশ্ন করলো টুকি।
আমাদের কয়েকজন দেখেছে। তবে কোনো মানুষ, মানুষের বাচ্চা কেউ দেখেনি।
- উত্তর দিলো তাহি।
তুই জানলি ক্যামনে? - প্রশ্ন করলো গুলু ?
আমি আসার সময় দেখলাম এই ঘটনা বলাবলি করে জুবু, দিচু ওর বন্ধুদের
সাথে মজা করছে। তোদের কাছে আসার সময় দেখি ওই মানুষটারে কয়েকটা মানুষ মিলে ভ্যানে
করে ডাক্তারের কাছে নিচ্ছে। - ব্যাখ্যা করলো তাহি।
নিক। ওদের তো তাও ডাক্তার আছে। আমাদের কিছু হলে তো যাওয়ার জায়গা
নেই। নিজেদের মনের আনন্দের জন্য আমাদেরকে মারে। গুলুর পা ভেঙে দিছে। চিকিৎসার
অভাবে গুলু এখন ল্যাংড়া। মানুষের এসব ভোগান্তি তাদের পাপের ফল। - যেন ক্ষোভ ঝাড়লো
ইশি।
আমরা তো মানুষের মত এত খারাপ না। ওরা আমাদের একজনকে মেরে ফেলেছে।
তাকে তো আর আমরা মেরে ফেলেনি। কয়েকটা কামড় খাইছে শুধু। একগাদা ইনজেকশন ফুটানো,
একগাদা টাকা খরচ, কয়েকদিন ইনকাম করতে পারবে না। তারপর তো আমার ঠিক হয়ে যাবে। আবারো
আমাদের কাউকে চাপা দিয়ে মারবে। - বললো ইকি।
দিক না চাপা। এক কামড়ে ওর গায়ের গোশতো তুলে আনবো। অনেকদিন
কাচা গোশতো খাই না। ওর গোশতো দিয়ে শখ পূরণ করবো। লাগতে আসুক আবার। দ্বীপ কি ওদের
বাপের? দ্বীপ আমাদের সবার। দ্বীপে তো আরো অনেকে থাকে। কেউ কি মানুষের ঘরবাড়িতে
গিয়ে থাকে? তাদের ঘরবাড়ি নষ্ট করে? তাহলে মানুষ কেন করে? অন্যদের ঘরবাড়ি নষ্ট করে,
তাদের মেরে মানুষের কিসে এত আনন্দ। সমুদ্র দেখবে ভালো কথা। সমুদ্র পাড় নোংরা করে
মানুষ। সমুদ্র পাড়ে লাল কাকড়ার ঘরবাড়ি নষ্ট করে মানুষ। বীচকে ওদের বাপের সম্পত্তি
ভেবে এমনভাবে গাড়ি চালায়, কাকড়াগুলো ওদের ঘর ছেড়ে পালিয়ে বাঁচারও সময় পায় না।
মাটির নিচে নিজের ঘরেই মাটিচাপা পড়ে। এই ছোট্ট কাঁকড়াটা কি ক্ষতি করেছিল মানুষের।
এমন আরো অনেক জীবন হত্যা করেছে মানুষ। সৃষ্টির সেরা জীব নাকি মানুষ। সেই মানুষই
মানুষকে প্রকাশ্যে খুন করলেও বিচার হয় না এই দেশে। আর অন্য প্রাণীদের মারলে কি আর
হবে। - তাহির এই কথাগুলো যেন ওদের সবার কথা।
একটু ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভাবলে কথাগুলো কিন্তু সত্যি ই। যে যার কাজ,
যে যার অবস্থানে থাকলে এত সমস্যা হয় না। রাস্তা দিয়ে চলবে গাড়ি। গাড়ি নিয়ে কেন
সমুদ্রপাড় নষ্ট করবে মানুষ। কেন অন্য প্রাণীদের মারবে? সৃষ্টির সেরা জীবনের এই
নমুনা? সৃষ্টিকর্তার তৈরী বাকি সতেরো হাজার নয়শো নিরানব্বইটা প্রাণীরা কি মানুষের
নামে সৃষ্টিকর্তার কাছে বিচার দেবে না? অবশ্যই দেবে। চাইলেই সব পারে বলে কি মানুষ
যা ইচ্ছে তাই করবে? মানুষের মুখে মধু, অন্তরে বিষ। ভালোবাসা দেখায় উপরে উপরে। একটা
বাঘকে দৌঁড়ে ছাগল ধরে খেতে দেখলে মানুষ ইস করে কষ্ট পায়। তারপর মাংস খাওয়ার লোভ
সামলাতে না রে বাজার থেকে ছাগলে মাংস কিনে এনে রান্না করে খেতে খেতে বাকিদেরকে
বাঘের হিংস্রতার গল্প শোনায়।
আল্লাহর কাছে একটা জিনিস চাই। একদিনের জন্য যদি সে মানুষদেরকে
আমাদের মত বানাইতো আর আর আমাদেরকে মানুষের মত বানাইতো। উচিৎ শিক্ষা দিতাম। এত ভালো
ব্যাবহার করতাম যে ওরা লজ্জাতেই সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে মরে যেত। - বললো ইকি।
বাইকয়ালার আপডেট কেউ পাইলে জানাস তো। না জানি বেচারার কি অবস্থা। -
ইশি।
এত আফসোস করতে হবে না। এটা ওর কর্মফল। আমি থাকলে আরো ২ টা কামড়
বেশি দিতাম। - তাহি উত্তর দিলো।
না। এটা ঠিক হবে না। যা করবে আমরাও তাই করবো নাকি? - বললো টুকি।
জাকিরের দোকানের বাক্স টিভির বাংলা সিনেমার পুলিশ হইছিস? কাহিনী
শেষে এসে বলবি আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না? - হাসতে হাসতে উত্তর দিলো ইশি।
সূর্য ডুবে গেলো। পেট চো চো করতেছি। - বললো টম
জাকিরের দোকানে গিয়ে জিব্বা বের করে থাকলে তো হালায় শুধু পানি
খাওয়াইবো।- যোগ করলো ইকি।
জেটিঘাটের দিকে একটা চক্কর দিয়ে আসবি নাকি? - প্রস্তাব দিলো ইশি।
চল, তাহলে বাইকয়ালার অবস্থাও জেনে আসতে পারবো। - বললো তাহি।
সবাই উঠে গা ঝাড়া দিয়ে গা থেকে বালু ঝাড়লো। একটু দূরেই একটা জুটি
ডাব খাচ্ছিল। ওদের সবার একসাথে উঠা দেখে মেয়েটা ভয়ে আতকে উঠে নিজের গায়েই পানি
ফেললো। যেন নাল পড়েছে। হাইরে আল্লাহর দুনিয়া। ওরা সাধারণ পানিটাও পায় না। আর মানুষ
এত এত টাকা দিয়ে ডাব কিনে খায়। প্রেমিক ছেলেটা ভাব নিয়ে ওদের দিকে মারমু্খি ভাব
নিয়ে প্রেমিকার কাছে হিরো হবে তখনই ইকি আর টুকিও চিৎকার করে ওদের দিকে তেড়ে গেলে।
ব্যাচ, হাউমাউ করে ডাব ফেলে দিলো দৌঁড়। এই চেঁচামেচি জাকির শুনেছিল। তবে তার
একটা বিশ্বাস আছে ওর সাগরেদরা মানুষের ক্ষতি করবে না যতক্ষণ না মানুষ ওদেরকে কিছু
বলবে।
এদিকে আস্তো ডাব পেয়ে ওরা তো বেজায় খুশি। ইশি গিয়ে জাকিরকে ডেকে
আনলো। দুটো আস্তো ডাব পড়ে থাকতে দেখে জাকিরও বুঝে নিলো ওকে ডাব কেটে দেবার জন্যই
ডেকেছে। বড় ভাগ্য করে আজ ওরা ডাব খেয়েছে সবাই।
.png)


No comments