Header Ads

মানুষ -- ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৫

 

Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, মানুষ, উপন্যাস, Novel, romantic bangla Novel, bangla Novel for love,  bangla Novel, কুকুর নিয়ে গল্প, পশু নিয়ে গল্প

একদিন সন্ধ্যা বেলা। সূর্য ডুবেছে একটু আগে। পশ্চিম বীচের ওয়াচ টাওয়ারের পাশে সমুদ্রের পাড়ে বালিতে বসে ওরা পাঁচ বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছে। ততক্ষণে জোয়ারের পানি বাড়তে শুরু করেছে। পশ্চিম বীচ ধরে জেটির দিকের রিসোর্টে আসার জন্য  বীচের পাড় দিয়েই শর্টকার্টে যাওয়া যায়। তবে পানি বেড়ে গেলে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। বীচের সেই ভেজা বালুতে ওরা গর্ত করে নিজেদের ঘর বানাচ্ছে। একেকজন দৌঁড়ে পানিতে একটা ডুব দিয়ে এসে গা ঝাঁড়া দিয়ে অন্য বন্ধুদের ভিজিয়ে দিয়ে খেলা করছে। এটা ওদের প্রায় সন্ধ্যারই খেলা। খেলা শেষ করে ওরা জাকিরের দোকানে যাবে। সিনেমা দেখার ভং ধরে জিহ্ব বের করে বসে থাকবে। ওদের জিহ্ব গাল থেকে বাইরে বের হয়ে থাকলে জাকির বোঝে যে ওরা ক্ষুধার্ত। আর জাকিরের এই মনের হাবভাব ওরাও বুঝতে পারে। ওরা মানুষের কথা বোঝে। তবে মানুষেরা ওদের সব কথা বোঝে না। এই বুদ্ধিটা বহু দিন ধরে ওরা কাজে লাগাচ্ছে। মানে আত্মসম্মানের জন্য ওরা খাবার চাইবে না, তবে দিলে খাবে। আপাতত জাকিরের দয়া ছাড়া সারা রাত না খেয়ে থাকা লাগবে। ওরা তো চোর, ছিনতাইকারী না। তাই এত কষ্ট। মানুষের মত যদি চুরি করতে পারতো, রাস্তায় মানুষকে একে পেয়ে কামড়ে ওর খাবারগুলো কেড়ে নিতে পারতো তাহলে আর খাবারের অভাব থাকতো না। মানুষের মত অন্যের হক মেরে খাওয়া, ফাঁকি দেওয়া, ব্যাংকের টাকা মেরে খাওয়া, কম দামে জিনিস কিনে অন্যদের জিম্মি করে বেশি দামে বিক্রি করা, একজনের বিপদের সুযোগে তার থেকে নিজের সর্বোচ্চ সুবিধা নেওয়া, এই কাজগুলোতে মানুষের বিকল্প কিছু নেই। মানুষ যদি জানতে পারে কাল কেয়ামত হবে তবে আজকে কাফনের কাপড়ের দাম বাড়িয়ে দেবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মানুষ কি আর ইহকাল পরকাল ভাবে? মানুষ ভাবে কারে মেরে খেয়ে চলা যাবে। অন্যকে ঠকিয়ে জুলুম করে সম্পদ অর্জনকে মানুষ অপরাধ হিসেবে দেখে না। দেখে নিজের চালাকি হিসেবে। নিজের স্বার্থে মানুষ অন্য মানুষকে, এমনকি নিজের বাপ ভাইকে মেরে ফেলতেও দুইবার ভাবে না। সেখানে মানুষের দ্বারা অন্য প্রাণীদের নিরাপত্তার কথা ভাবাটাও বোকামি। মানুষ ওদের উপর যতই অত্যাচার করুক, মানুষের উপর তারা কখনোই এতটা অমানবিক না, যতটা মানুষ। হয়তো মানুষের অত্যাচার অপরাধগুলোর প্রতিবাদে তারা উচ্চস্বরে চিল্লাচিল্লি করে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তার থেকেও বেশি কিছু করে। তবে বেশিরভাগ সময় চিল্লাচিল্লি করে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য, মানুষ যেমন কাউকে ডাকার জন্য উচ্চস্বরে কথা বলে, উচ্চস্বরে ডাকে, ঠিক তেমনটা। আর কামড় দেওয়া? ভুল ভবিষ্যৎ কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বাকি সময় এটা তাদের প্রতিবাদের শেষ ধাপ। মানুষকে তারা আঘাত করতে পারে এই ভয়ে যদি মানুষ তাদের উপর চড়াও হয়, তাহলে তাদের উপর চড়াও হওয়ার প্রতিবাদে তারা কেন মানুষকে কিছু বলবে না? বলাটা কি স্বাভাবিক না?

 

বালুতে গর্ত করে খেলা করার সময় ইশি খেয়াল করলো দুজন মানুষ ধীর পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। দুজন দুজনের হাত ধরে রেখেছে। একটা ছেলে মানুষ, আরেকটা মেয়ে মানুষ। বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড হবে মনে হয়। এই দ্বীপে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ভাইবোন ঘুরতে আসে না। যদি ছেলে মেয়ে দুজন ঘুরতে আসে তাহলে বুঝতে হবে ওরা বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড অথবা জাস্ট ফ্রেন্ড। সত্যি সত্যি বিবাহিত হলেও হাবভাবে বোঝা যায়। নতুন বিবাহিত হলে ফ্রি হতে সময় লাগেম আর বিয়ে কিংবা প্রেমের বয়স বেশিদিন হয়ে গেলে এমন আলগা পিরীত আর থাকে না। ওদের দিকে এগিয়ে আসা মানুষ দুজন বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড অথবা জাস্ট ফ্রেন্ডই হবে। ইশি, তাহি, গুলু, ইকি, টুকি ওদের মত খেলা করছে। আর মানুষ দুজন ওদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলে মানুষটা মেয়ে মানুষটার হাত ধরে আছে। মেয়ে মানুষটা ছেলে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে আছে। ওদের গায়ের কাপড়গুলো ভেজা। সদ্য সমুদ্র থেকে উঠেছে বলে কাপড় ভেজা থাকতে পারে। নাকি ওদের ভয়ে কাপড় ভিজিয়ে ফেলেছে সেটা এই অন্ধকারে বোঝা মুশকিল। টুকি সমুদ্রে গা ভিজিয়ে মানুষদুটোর কাছাকাছি গিয়ে গা ঝাড়া দিল দুষ্টুমি করে। মানুষ দুজন আরো আটোসটো হয়ে দাঁড়িয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করছে।

দেখ দেখ ওরা মনে হয় আমাদের ভয় পাচ্ছে। - ইশি সবাইকে দেখালো।

আর একটু ভয় দেখাবো নাকি? - ইকি মজা করতে চাইলো।

দেখ ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করছে। আমি সিওর, ওরা হয় ওদের আল্লাহরে ডাকছে আর নাইলে ভগবানরে ডাকছে। - গুলুও বেশ মনোযোগ দিয়ে মানুষদুটোরে পর্যবেক্ষণ করলো।

আল্লাহ তো ইনডিরেক্টলি আমাদের সোয়াব দিবে। কি বলিস তোরা? - টুকি বললো।

কেন? আমরা আবার কি করলাম? - প্রশ্ন করলো তাহি।

আরে আমাদের ভয়ে হলেও ওরা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছে। মানুষ নিজের ভালো সময়ে সৃষ্টিকর্তাকে খুব একটা স্মরণ করে না। মানুষ জাত সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেই কেবল বিপদে পড়লে। - উত্তর দিলো ইকি।

তা ঠিক। মানুষ বিপদে পড়ে একবেলাতে যে কয়বার আল্লাহ, ভগবানকে ডাকে, সারা মাসেও এতবার ডাকে বলে মনে হয় না। - যোগ করলো ইশি।

চল এক কাজ করি, ওদের ঘিরে ধরে ওদেরকে আরেকটু ভয় দেখাই। - প্রস্তাব দিলো ইকি।

ভুলেও না। মানুষ কেমন, চিনিস না? সামান্য মজা করতে গিয়ে ইট মেরে গুলুর পা ভেঙে দিয়েছে। যতদিন বেঁচে থাকবে ওকে তিন পায়ে হাটতে হবে। মানুষের দিয়ে ভরসা নেই। দুনিয়ার সব থেকে খতরনাগ প্রাণী হচ্ছে মানুষ। এরা কখন কি করে, কি জন্য করে তারে প্রশ্ন করলে সে নিজেই উত্তর দিতে পারবে না। - নিষেধ করলো তাহি।

হুম সেটাই। যদি ইট মেরে বসে, আমরাই ব্যাথা পাবো। এলাকায় যে দু-একটা ফার্মেসি আছে, সেখানে তো আমাদের মাগনা ওষুধ দেবে না, ব্যান্ডেজ করে দেবে না। আমাদের কাছে তো টাকা নেই। - বললো ইশি।

মানুষ আমাদের খাইতেই দেয় না। আবার করবে চিকিৎসা, তাও আবার মাগনা! - যোগ করলো টুকি।

আচ্ছা শুনেছি পশু ডাক্তার আছে। তার কাজ কি? - প্রশ্ন করলো ইকি।

তার কাজ হচ্ছে পশুদের চিকিৎসা করা। - উত্তর দিলো তাহি।

তাইলে আমাদের করবে না কেন? - প্রশ্ন করলো টুকি।

পশু ডাক্তার পশুর চিকিৎসা করবে কিন্তু টাকা নেবে মানুষের থেকে। পশু ডাক্তার পশুদের তো মাগনা চিকিৎসা করে না। - গুলু উত্তর দিলো।

তাহলে ওর নাম পশু ডাক্তার কেন? - আবারো প্রশ্ন করলো ইকি।

দেখ দেখ বুকে থুতু দিতেছে। - সবাইকে দেখালো তাহি।

তা দেখছি। এতক্ষণ ধরে নিজেদের বুকে যে পরিমাণ থুথু দিয়েছে। রাত্রে বেলা হোটেলে ফিরে দুজন দুজনরে জড়াইয়ে ধরলে থুথুর গন্ধ ছাড়া কিছুই পাবে না। - হাসতে হাসতে বললো ইকি।

থুথুর গন্ধ পাওয়ার কি আছে। যখন চুম্মাচাটি খায় তখন তো থুথুই খায়। - হেসে উত্তর দিলো গুলু।

তুই বেশি দুষ্টু হয়ে যাচ্ছিস রে গুলু। - বললো ইকি।

আমি দুষ্টু আর তুই তো পীর সাব। - কথা মাটিতে পড়ার আগেই উত্তর ফিরিয়ে দিলো গুলু।

আচ্ছা বাদ দে। ওদের যেতে দে। মানুষ খারাপ বলে আমরাও কি ওদের সাথে খারাপ করবো নাকি? অপরিচিত এলাকা, কদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। রাস্তাঘাট ঠিকমতো চেনে না। বীচ ধরে শর্টকাট যেতে না পারলে অনেক ঘুরে যেতে হবে। খালি খালি ভোগান্তিতে পড়বে। আর দুজনকে এই নির্জন সময়ে যেতে দেখলে তাদেরকে আটকে জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া, ছেলেটাকে বেঁধে রেখে মেয়েটাকে ধর্ষণ করা এসব মানুষের পুরোনো অভ্যাস। যদিও সব মানুষ খারাপ না। তবে যারা খারাপ তারাও তো মানুষ। অমানুষগুলো দেখতে হুবহু মানুষের মত। তাই বিপদে পড়ার আগে তাদেরকে আলাদা করা যায় না। - সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছে ইশি।

একটা কাজ করি চল। ওদের ধাওয়া দিই। এক দৌঁড়ে ওরা হোটেলে পৌঁছে যাবে। এখানে দাঁড়িয়ে ওদের অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। দৌঁড়ে হোটেলে ফিরলে টাইম একটু এ্যাডজাস্ট হবে।  - বুদ্ধি দিলো ইকি। বলেই হেসে উঠলো।

তোর মাথায় কি শয়তানি বুদ্ধি ছাড়া কোন বুদ্ধি নাই? - বললো ইশি।

শয়তানির কি করলাম? ভালো বুদ্ধি ই তো দিলাম। - উত্তর দিলো ইকি।

 

ভেজা কাপড়ে মানুষ দুটো তখনো কাঁপছে। সাগরের পানি বাড়তে শুরু করেছে। সাগরের  এই পাড় দিয়ে মানুষের চলাচল কমে গেছে। ওরা ভয়ে ওখানেই থমকে আছে। অপেক্ষা করছে আর কয়েকজন মানুষ আসে কিনা সেজন্য। তাহলে তাদের সাথে এরাও বিপদ কাটিয়ে চলে যেতে পারবে। তবে প্রবাদ আছে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। অনেকক্ষণ হয়ে গেল কেউ এ পথ দিয়ে আসা-যাওয়া করছে না। ইকি হঠাৎ একবার জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলো। মেয়ে মানুষটা ভয়ে ছেলে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরলো।

আরে দেখ দেখ, জাকিরের টিভিতে বাংলা সিনেমায় এরকম সীন আমি দেখেছি। নায়িকা ভয় পেয়ে নায়ককে এভাবে জাপটাই ধরে। অবশ্য একটা পার্থক্য আছে। টিভিতে নায়িকা নায়ককে জাপটায় ধরে, তারপরই গানের ভিতরে ওরা সমুদ্র পাড়ে দৌঁড়ায় আর নাচতে নাচতে গান গায়। আর বাস্তবে এই দুই নায়ক-নায়িকা জাপটায় ধরার আগেই সমুদ্র পাড়ে এসে হাজির। - হাসতে হাসতে ব্যাখ্যা করলো ইকি।

আচ্ছা চল ওদের আর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। ক্ষুদা লাগছে। পানিতে বালি ধুয়ে জাকিরের দোকানের দিকে চল। এমন করলে মানুষ হুদাই আমাদের কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেবে। - বললো তাহি।

এটা গালির কি হল। আমরা যা, তাই ই তো বলছে। গালি তো হবে তখন যখন মানুষকে কেউ কুত্তার বাচ্চা বলে গালি দেবে। - উত্তর দিলো গুলু।

পৃথিবীর সবচে ভেজাইলে মনের প্রাণী হল মানুষ। কখন কোন কথায় কি রিয়াক্ট করা উচিৎ এটাই মানুষ জানে না। যেমন ধর মানুষরে কুকুরের বাচ্চা বললে ভাবে যে গালি দিচ্ছে। তখন সে রেগে যায়। সেই মানুটাকেই যদি কেউ বাঘের বাচ্চা বলে তাহলে সে ভাবে তার প্রশংসা করছে। সে খুশি হয়। অথচ কুকুরও প্রাণী। বাঘও প্রাণী। - হাসতে হাসতে উত্তর দিলো ইশি।


২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বীর শহিদ ও অকুতোভয় আন্দোলনকারীদের স্মরণে ও সম্মানে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস বাংলা বসন্ত। অর্ডার করতে ক্লিক করুন

No comments

Powered by Blogger.