মাদক সম্রাট 'এল মায়ো' জাম্বাডা যেভাবে ৩৫ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেফতার হলেন || শাহরিয়ার সোহাগ
ইসমায়েল 'এল মায়ো' জাম্বাডা মাদক সাম্রাজ্যের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত নামগুলোর মধ্যে একটি।
তিনি বিশ্বের সবচেয়ে অন্যতম প্রধান মাদক চোরাকারবারি চক্র বা ড্রাগ কার্টেলের ভয়াবহ শক্তিধর ব্যক্তিদের একজন এবং এই সাম্রাজ্যে ব্যাপক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এই ড্রাগ কার্টেলের মাদক সম্রাটরা তাদের অবৈধ মাদক ব্যবসার আধিপত্য ধরে রাখতে এবং বেশি বেশি লাভ করতে একে অপরের সাথে যোগসাজশের ভিত্তিতে কাজ করতো।
বলা হয় জাম্বাডা হলেন ড্রাগ কার্টেল নেতাদের প্রকৃত প্রজন্মের সবশেষ সদস্যদের একজন।
উত্তর-পশ্চিম মেক্সিকোর শহর কুলিয়াকানে আসবাবপত্রের ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করার পর, ১৯৭০-এর দশকে একজন পাচারকারী হিসেবে তিনি তার আন্ডারওয়ার্ল্ড ক্যারিয়ার শুরু করেন।
একজন সাধারণ পাচারকারী থেকে জাম্বাডা এতোটা উত্থান লাভ করায় তাকে "ক্যাপো দে ক্যাপোস" (নেতার নেতা) বলা হয়। তিনি আরেক কুখ্যাত মাদক কারবারি জোয়াকিন 'এল চ্যাপো' গুজম্যানের সাথে ১৯৮৯ সালে সিনালোয়া কার্টেল নামে এক মাদক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।
ওই বছর গুয়াদালাজারা কার্টেল নামে একটি মাদক কারবারি সংগঠন ধসে পড়েছিল। ওই সংগঠনের অবশিষ্টাংশ থেকে নতুন করে সিনালোয়া কার্টেল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
জাম্বাডা শুরুতে গুয়াদালাজারা কার্টেলের জন্য কাজ করতেন। ওই প্রতিষ্ঠানটি আফিম, গাঁজা এবং সবশেষ কোকেনের ব্যবসা করত। তার কুখ্যাত সহচর এল চ্যাপো যেখানে দুবার জেল খেটেছেন এবং জেল থেকে পালিয়েছেন সেক্ষেত্রে জাম্বাডার গল্প একদম ভিন্ন। তিনি প্রায় ৩৫ বছর ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিলেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বৃহস্পতিবার টেক্সাসের এল পাসো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করে।
মার্কিন আইনপ্রণেতারা ফেব্রুয়ারিতে জাম্বাডার বিরুদ্ধে ফেন্টানাইল তৈরি ও বিতরণের অভিযোগ আনে, যা কিনা হেরোইনের চেয়েও শক্তিশালী একটি মাদক, যেটা আসার পর যুক্তরাষ্ট্রে সিনথেটিক ওপিওডের ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়ে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক পাচার, খুন, অপহরণ, মানি লন্ডারিংসহ আরো নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
ইতিমধ্যে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা এসব একাধিক অভিযোগে টেক্সাসের ফেডারেল আদালতে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন।
জাম্বাডাকে মূলত ছলে বলে কৌশলে একটি ব্যক্তিগত বিমানে তোলা হয়। জাম্বাডা ভেবেছিলেন তিনি দক্ষিণ মেক্সিকোতে একটি গোপন বিমান ওঠানামার স্থান পরিদর্শন করতে যাচ্ছেন। কিন্তু তাকে এল পাসো শহরে টেক্সাসের বাইরে একটি ব্যক্তিগত বিমান ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। এভাবে গোপন ফাঁদ পেতে চালানো অভিযানে তাকে কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেই অভিযানের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তার সাবেক সহযোগী এল চ্যাপোর ছেলে। বিমান অবতরণের পর মার্কিন কর্মকর্তারা জাম্বাডার পাশাপাশি এল চ্যাপোর ছেলে এবং তার অন্যতম উত্তরাধিকারী, ৩৮ বছর বয়সী জোয়াকিন গুজমান লোপেজকেও গ্রেফতার করে।
মার্কিন গণমাধ্যম ফক্স নিউজের প্রতিবেদক ব্রায়ান লেনাস বলেছেন যে লোপেজ মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং জাম্বাডাকে ধরিয়ে দেন কারণ তিনি "তার বাবাকে (এল চ্যাপো) গ্রেফতারের পেছনে জাম্বাডাকে দায়ী করেন"।
এল চ্যাপোর বিচার চলাকালীন, তার আইনজীবীরা জাম্বাডার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে বলেছিলেন, জাম্বাডা কোন ভয় ছাড়া যেন খোলামেলাভাবে জীবনযাপন করতে পারে তার জন্য পুরো মেক্সিকান সরকারকে ঘুষ দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের মাদকবিরোধী বাহিনী ইউএস ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ডিইএ) জাম্বাডাকে ধরার জন্য দেড় কোটি ডলার পর্যন্ত পুরস্কারের ঘোষণা করেছিল।
"আপনি যেকোনো সময় ধরা পড়তে পারেন, এই ভেবে কী আপনি চিন্তিত?" জাম্বাডাকে ২০১০ সালে এই প্রশ্নটি করেছিলেন প্রয়াত মেক্সিকান সাংবাদিক জুলিও শেরার গার্সিয়া। এই মাদক সম্রাটের এক বিরল সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য তিনি পাহাড়ের গহীনে গিয়েছিলেন।
“আমাকে জেলে পাঠাতে পারে, এই ভাবনায় আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই," জাম্বাডা উত্তরে বলেছিলেন।
"আমি জানি না যে তখন আমি কিভাবে আত্মহত্যা করবো। আমার মনে হয় আমি তাই করব এবং আমি আমার নিজের জীবন নেব।" তিনি যখন আসলেই গ্রেফতার হলেন তখন তার কাছে আত্মহত্যা করার উপায় বা সুযোগ- কোনটাই ছিল না। জাম্বাডা, যিনি এত বছর ধরে এতোটা সতর্ক থেকেছেন তার মতো মানুষের ৭৬ বছর বয়সে এসে ফাঁদে পা দেয়া একটি অসাধারণ ঘটনা বলেই ধরে নেয়া যায়।
তাকে গ্রেফতার করতে এবং কারাগারে নিতে এরকম অভিনব কিছুরই প্রয়োজন ছিল।
"এতে আমি অবাক হই না যে জাম্বাডাকে এতদিন ধরা যায়নি," প্রাক্তন ডিইএ এজেন্ট মাইক ভিজিল বলেছেন, "তার বয়স এখন ৭০-এর কোঠায়, স্বাস্থ্যের অবস্থা তেমন ভালো না এবং তিনি ইতিমধ্যেই বলেছেন যে কারাগার তার সবচেয়ে বড় ভয়ের জায়গা।"
সিনালোয়া কার্টেলের অন্যতম প্রধান এল চ্যাপোকে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।ছবির উৎস,Getty Images
ছবির ক্যাপশান,সিনালোয়া কার্টেলের অন্যতম প্রধান এল চ্যাপোকে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
এই গ্রেফতারের ঘটনা - এবং এল চ্যাপোর ছেলেরা যাদের কিনা লস চ্যাপিটোস নামে পরিচিত তাদের সাথে মার্কিন সরকারের সম্ভাব্য আবেদনের চুক্তি একটি প্রশ্নই ছুড়ে দিচ্ছে যে, সিনালোয়া কার্টেলের নিয়ন্ত্রণ কারা নেবে।
লস চ্যাপিটোস হল এল চ্যাপোর সন্তানদের নিয়ে গঠিত একটি সেল। যার অর্থ ক্ষুদে চ্যাপোরা।
এল চ্যাপো গুজম্যানকে ২০১৬ সালে গ্রেফতার করার পর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়া হয়।
এরপর থেকে ওই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মাদক ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায় এবং ব্যাপ্ক রক্তপাত হয়।
সেই সাথে বিরোধী বিভিন্ন মাদক চক্র যারা কিনা কিছুটা দুর্বল তাদের বিরুদ্ধেও তুমুল লড়াই শুরু করে তারা।
সিনালোয়া কার্টেলের নেতা ওভিডিও গুজমান লোপেজ যখন ২০১৯ সালের অক্টোবরে গ্রেফতার হন তখন ওই প্রতিষ্ঠানটির বন্দুকধারীরা যেভাবে এর জবাব দিয়েছিল তা ছিল ভীষণ মর্মান্তিক এবং হিংসাত্মক।
ওভিডিওকে আটক করার পর, শত শত বন্দুকধারী কুলিয়াকান শহরে নেমে আসে এবং পয়েন্ট ৫০ ক্যালিবার অস্ত্র এবং রকেট লঞ্চার দিয়ে বেসামরিক নাগরিক, পুলিশ এবং সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বেপরোয়া হামলা চালায়
অবশেষে, যুদ্ধের ইতি টানতে, কর্তৃপক্ষ ওভিডিও গুজম্যানকে তার লোকদের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।
পরে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়, প্রত্যর্পণ করা হয় এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগারে তিনি বিচারের অপেক্ষায় আছেন।
মাইক ভিজিল মনে করেন, কুলিয়াকান শহরে যে সহিংসতা হয়েছিল যা কিনা কুলিয়াকানাজো নামে পরিচিত, এমন সহিংস পরিস্থিতি আজকের সময়ে এড়ানো যেতে পারে:
"সিনালোয়া কার্টেলের সম্ভাব্য নেতাদের খুব শক্তিশালী একটি বেঞ্চ রয়েছে যেখানে কিনা এল চ্যাপোর ভাইও আছেন যারা প্রতিষ্ঠানটির পরবর্তী দায়িত্ব নিতে পারেন," তিনি বলেছেন।
প্রকৃতপক্ষে, মি. ভিজিলের দাবি, "কিংপিন কৌশল" খুব একটা সফল হয়নি। কিংপিন কৌশল মূলত এমন এক ধরনের কৌশল যেখানে মাদক কারবারি সংগঠনগুলোর প্রতিটি কার্টেল নেতাদের দমাতে পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
"তৎকালীন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ফেলিপ ক্যালডেরনের প্রশাসনের অধীনে, এই কৌশলের মাধ্যমে বিভিন্ন মাদক কার্টেলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তৈরি করা হতো যার কারণে প্রচুর রক্ত ঝরেছিল।"
''যদি এখনকার সময়ে এমনটা হয়, তাহলে এক্ষেত্রে শুধুমাত্র তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী, জলিসকো নিউ জেনারেশন কার্টেল (সিজেএনজি) বিজয়ী হবে" প্রাক্তন ডিইএ এজেন্ট মাইক ভিজিল এমনটাই মনে করেন।
বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক এসব ঘটনাপ্রবাহ এবং এখন যে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছে, এমন অবস্থায় মেক্সিকোর দলগুলোর মধ্যে কি ধরনের ক্ষমতার লড়াই শুরু হবে তা বলা যাচ্ছে না।
মেক্সিকান কর্তৃপক্ষ সহিংসতা শুরু হওয়ার আগেই সিনালোয়া রাজ্যে অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করেছে।
জাম্বাডাকে গ্রেফতারের এই অভিযানটি কয়েক মাস ধরে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে এতে কিছু বাড়তি সুবিধা দেয়ার বিষয়ও ছিল।
মার্কিন কর্তৃপক্ষের মধ্যে শুরু থেকেই এই অভিযান নিয়ে অনেক সংশয় ছিল।
কিন্তু যখন তাদের এই পরিকল্পনার বিভিন্ন কৌশল একে একে জোড়া লাগতে থাকে তখনই তারা শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয় তারা এই অভিযান চালাবে।
কেননা এই চেষ্টার ফলে তাদের কিছুই হারাতে হবে না। এই অভিযান সফল হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ‘সময়’।
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ডের এক ভিডিও বার্তায় গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন:
"আমাদের দেশ যতো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে তারমধ্যে ফেন্টানাইল সবচেয়ে মারাত্মক



No comments