মানুষ -- ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৩
কাস্টমার
যেন তার দোকানে বেশিক্ষণ বসে বিশ্রাম নিতে পারে, সেজন্য হাতপাখা আর টিভির
ব্যবস্থাও রেখেছে জাকির। কাস্টমার যত বেশি সময় থাকবে, তত বেশি বিক্রির সম্ভাবনা।
বুদ্ধিটা অবশ্য খারাপ না। যদিও টিভিতে বাংলা সিনেমা ছাড়া কিছুই চালায় না সে।
বাংলা সিনেমার প্রতি জাকিরের একটা বিশাল টান আছে। জাকিরের বয়স তখন আটাশ-ত্রিশ
হবে। এই দ্বীপে কিছু মানুষ সিনেমার শুটিং করতে এসেছিলো। একটা দৃশ্যের জন্য কয়েকজন
লোক দরকার ছিল। এই দ্বীপে অভিনয়ে আগ্রহীদের সুযোগ দিতে চাইলেন পরিচালক। গাংচিল
যেভাবে জাহাজের মানুষের থেকে চিপস লুফে নেয়, জাকিরও ঠিক সেভাবে সুযোগটা লুফে নিলো।
শুটিং এর আগের দিন রাতে দ্বীপের বাজার থেকে গোলাপী রংয়ের একটা টাইট ফিটিং শার্ট,
একটা প্যান্ট আর একটা লাল স্যান্ডেল কিনলো। সেভ করে মুখটা গরম পানিতে মুরগির পালক
পরিষ্কার করার মত ফকফকা বানালো। এক কৌটা পাউডার কিনলো। কড়া একটা আতর আর একটা পকেট
চিরুণী কিনলো। পরদিন ফজরের নামাজ পড়ে রেডি হয়ে আলো ফোটার আগেই শুটিং টিমের
হোটেলের সামনে হাজির হলো জাকির। প্যান্ট শার্ট ইন করা, পায়ে লাল স্যান্ডেল, মুরগি
ছিলা গাল আর গলা ভর্তি ধবধবে সাদা পাউডার। সাথে কড়া আঁতরের ঘ্রাণ। ঘুম ভাঙা চোখে
বাইরে ব্রাশ করতে বের হওয়া প্রোডাকশন বয় শ্যামলা কালো জাকিরের এত সকালে এমন বেশে
দেখে ভয় পেয়ে বুকে থুত্তুড়ি দিতে গিয়ে ভুলে পেস্টের ফেনা দিয়ে দিয়েছিল। কি যে
একটা বিদিখিস্তি অবস্থা। এত টাকা খরচ করে এত সাজ দিয়ে যাওয়া জাকির আশা করেছিল
পরিচালক তাকে নায়কের পার্ট না দিলেও নায়কের পাশের বন্ধুর পার্টটা দিবেই দিবে।
কিন্তু না, পরিচালক তাকে দিলো লাশের চরিত্র। সমুদ্রে ভেসে আসা একটা লাশ উপুড় হয়ে
পড়ে আছে। ক্যামেরাম্যান সমুদ্র দেখাতে দেখাতে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লাশটা এক ঝলক
দেখাবে। ব্যাস, এতোটুকুই। যথারীতি কাদা পানিতে জাকিরকে উপর হয়ে শুইয়ে রাখা হলো।
মনের আফসোসে জাকির হু হু করে কেঁদে উঠলো। পরিচালক জাকিরকে এত বুঝালো যে ভাই লাশ তো
এ্যামনে নড়ে না, আপনি নড়ছেন কেন? নড়াচড়া করা যাবেনা। ক্যামেরাম্যান আবার শর্ট
নিলো। জাকির হু হু করে কাঁদতে গিয়ে আবারও নড়ে উঠলো। পরিচালক রাগে জিদে এই শর্টটা
ই বাদ দিয়ে দিলো। এরপর অবশ্য এই দ্বীপে তার বয়সী অনেকেই তাকে নায়ক জাকির বলে
খ্যাপাতো। জাকির খুব কষ্ট পেতো। কিন্তু কাউকে বলতে পারতো না। বাংলা সিনেমার প্রতি
ভালবাসাতে দোকানে বসে সারাদিন বাংলা সিনেমা দেখে। কাস্টমার এসে কিছু চাইলে তাকে
সেটা দেয়। তারপর আবার সিনেমা দেখে। তাহি, ইশি টুকি, ইকি, গুলুর যখন ক্ষুধা লাগে
তখন ওরা দোকানে এসে সিনেমা দেখার ভং ধরে। জাকির ওদের খেতে দেয়। সিনেমা দেখার ভং
ধরতে ধরতে কখনো কখনো ওরা সিনেমার ভিতরেই হারিয়ে যায়। এই যেমন এখন। ভিলেন এসে
বস্তিতে থাকা নায়িকা আর কিছু মানুষকে তুলে নিয়ে যেতে চায়। তখন গাংচিলের মত নায়ক
উড়ে এসে ডিসুম করে ভিলেনের পেটে একটা লাথি মারে। নায়কের এক লাথি খেয়ে ভিলেন দুই
নারিকেল গাছ সমান দূরে গিয়ে পড়ে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক ধুলো ওড়ে। ভিলেনের
সাঙ্গবাঙ্গরা নায়ককে ঘিরে ধরে। নায়ক মুখ দিয়ে ঢিশুম, ডিসুমাইক শব্দ করতে করতে
ভিলেনের লোকদের কখনো ঘুষি মারে, কখনো লাথি মারে, কখনো নিজের মাথা দিয়ে
গুন্ডাপান্ডাদের মাথায় গোল দেওয়ার মতো ঠুয়া মারে। এত টাকা দিয়ে এতগুলো গুন্ডা
পান্ডা পুষেও এই বস্তিতে থাকা নায়কের সাথে ভিলেন পারে না। নায়ক নায়িকাকে উদ্ধার
করে। এমন দৃশ্য দেখে ওরা খুব আনন্দ পায়। আর মনে মনে ভাবে এত খরচ করে এতজনকে না
পুষে শুধু নায়করে পুষলেই তো পারে। ভিলেনটার মাথায় গোবর, কোনো বুদ্ধি নেই।
ওই
পাড়ার মিকা তোমার দিকে যদি আর কখনো খারাপ চোখে তাকায়, আমি এই নায়কের মত উড়ে
গিয়ে ওর পেটে লাথি মেরে ভসকায়ে দেবো। - নিজের জায়গা বদলে তাহির কাছে গিয়ে বসলো
ইকি। ইকি যে তাহিকে ভালোবাসে এটা ওদের বন্ধু মহলের সবাই জানে। তাহিও জানে, তবে এত
দ্রুত রাজি না হয়ে ইকিকে একটু বাজিয়ে দেখছে আর কি। ইকি নিজের ভাগের খাবার অর্ধেক
খেয়ে বাকি অর্ধেক তাহিকে খাওয়ায়। এই দ্বীপে এমনিতেই ওদের মাঝে খাবারের জন্য
হাহাকার লেগেই থাকে। এখানে নিজের খাবার অন্যকে অল্প একটু দেওয়া মানেই হলো
ভালোবাসার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। এই দ্বীপে ভালোবাসার জন্য এর চেয়ে বড় আর কোনো
স্যাকরিফাইস হতেই পারে না। ইকি সেটাই করছে। গুলুর হঠাৎ হুশ হলো। গুলু সবাইকে মনে
করিয়ে দিলো জাহাজের সময় হইছে। - সবাই তাড়াতাড়ি জেটি ঘাটে চল। দেখি কোনো খাওন
পাওয়া যায় কিনা। টুকি চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে সূর্যের দিকে এক পলক তাকালো।
সূর্যের অবস্থান দেখে হিসেব করে বললো জাহাজ আসতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না। জাকির
ওদেরকে যে বিস্কুট দিয়েছিল তা না খেয়েই সবাই মিলে দৌঁড় দিলো জেটি ঘাটের দিকে।
ওরা জানে এই বিস্কুট পরে আসলেও ওরা পাবে। ওদের এমন দৌঁড়ে চলে যাওয়া দেখে জাকির
ওদের গালি দেয় - কুকুরের পেটে ঘি ভাত সয়না। যদিও এমন ঘটনা নতুন না। জাকির বিড়বিড়
করে বলে মোল্লার দৌঁড় তো মসজিদ পর্যন্ত। আর তোদের দৌঁড় এই আমার দোকান পর্যন্তই। এই
দ্বীপে তোদের এই জাকির বাপ ছাড়া আর কোনো বাপ খাওয়াবে না। আনমনেই এসব কথা বলতে বলতে
দোকানে আসা কাস্টমারের দিকে মনোযোগী হয়ে গেলো জাকির। তার দোকানটা সমুদ্রপাড়ে
হওয়াতে মানুষের আনাগোনা বেশি। আর আশেপাশে আর কোনো দোকানও নেই। তাই দ্বীপের এই
জায়গাটুকুতে জাকির স্বঘোষিত বড় ব্যবসায়ী। তার যদি মনে হয় কোনো কাস্টমার ক্যাচাল
করতে পারে, সে তার কাছে কোনো জিনিস ই বিক্রি করে না। আর কোনো কাস্টমারকে তার মনে
ধরলে তার সাথে গল্প জমিয়ে দেয়। নিজের বাড়ির গল্প, বিয়ের গল্প, তার নায়ক হবার গল্প
সব বলে। কাস্টমার শুনতে না চাইলে তারে ফ্রিতে চা খাওয়ানোর লোভে ফেলে হলেও তার গল্প
শোনাবেই শোনাবে।
তখনো
জাহাজ আসেনি। তবে দূরে জাহাজের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। পিঁপড়ারা যেমন দল বেঁধে চলে,
দূর সমুদ্রে সারিসারি এই জাহাজগুলোকে তেমনটা মনে হচ্ছে। প্রতিদিন এমন তের চৌদ্দটা
জাহাজ ভর্তি মানুষ আসে এই দ্বীপে বেড়ানোর জন্য। এই মানুষগুলোর উপরই এই দ্বীপের
মানুষ, প্রাণীদের পেটে খাবার নির্ভর করে। একটা জাহাজ যতই বড় হোক না কেন, মাঝ সমুদ্রে
সেটা নিতান্তই তুচ্ছ। বড় একটা ঢেউ আসলেই সব শেষ। যদিও যখন সমুদ্র উত্তাল থাকে তখন
জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উত্তাল সমুদ্র এই দ্বীপের জন্য অভিশাপ। মানুষের জন্য
আরো বড় অভিশাপ।
ওরা
পাঁচ বন্ধু জেটি ঘাটের ব্রীজের শুরুতেই দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজগুলো নোঙর করার অপেক্ষায়
আছে। তীব্র শব্দে হুইসেল বাজাচ্ছে। ব্রিজের শুরুতে অনেক মানুষের ভিড়। ভ্রমণ শেষে
ওরা এসব জাহাজেই ফেরার অপেক্ষায়। জাহাজের মানুষগুলো আগে নেমে লোকালয়ে আসবে। তারপর
এই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো জাহাজে উঠবে। গুলু আর ইকি বুদ্ধি করে এসব মানুষের ভিড়ে
একটু ঘোরাঘুরি করে দয়ালু মানুষের সন্ধান করছে। কি অদ্ভুত! একটাও দয়ালু মানুষ নেই!
অথচ এদের অনেক হাতেই চিপচের প্যাকেট। এই দ্বীপে সব জিনিয়ের দাম গায়ের দামের চেয়ে
বেশি। তাও মানুষ বেশি দাম দিয়ে চিপস কিনেছে গাংচিলদের খাওয়ানোর জন্য। তারপর সেই
চিপসের খালি প্যাকেট ফেলবে সমুদ্রে। বুক ভরা হতাশা নিয়ে ওরা দুজন ফিরে গেলো বাকি
বন্ধুদের কাছে। পাঁচ বন্ধু মিলে জেটিঘাটের ব্রীজে দাঁড়িয়ে দেখছে ঝাঁকে ঝাঁকে
গাংচিল জাহাজের সাথে সাথে উড়ে আসছে, মানুষ তাদেরকে চিপস খাওয়াচ্ছে। জাহাজেও তো
সব জিনিসের দাম বেশি হয়, তাহলে কি মানুষ দামের থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনে
পাখিদেরকে চিপস খাওয়াচ্ছে! সত্যি! মানুষ এত মানবিক! এত পশু-পাখি প্রেমী! ওরা পাঁচ
বন্ধু এটা যেন বিশ্বাস ই করতে পারে না। কারণ একমাত্র জাকির বাদে মানু্ষের সাথে
ওদের পাঁচবন্ধুর কারোর ই অভিজ্ঞতা ভালো না।
.png)


No comments