নন্দিত ও নিন্দিত দেশ মিয়ানমার || শাহরিয়ার সোহাগ
প্রায় তেরো হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের দেশ মিয়ানমার। এক সময় পরিচিতি ছিল সভ্যতা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য। আধুনিক কালে ওই দেশের প্রতি আগ্রহী করে তোলে অং সাং সুচীর জন্য। আর বর্তমানে মিয়ানমার খুবই নিন্দিত দেশ কেবলমাত্র সামরিক জান্তা দ্বারা শোষিত রোহিঙ্গা নির্মুলের কারণে। তবুও দেশটা সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান থাকা তো মন্দ নয়।
পিউ নামের উপজাতিরা ১ম শতকে বার্মা এলাকাতে দক্ষিণ দিকের ইরাবতী উপত্যকা দিয়ে প্রবেশ করে। অপর দিকে উত্তর দিক দিয়ে মুন জাতি প্রবেশ করে। ৯ম শতকে মিরানমা জাতি ইরাবতী উপত্যকার উপরে বসবাস শুরু করে। ১৩ শতকের দিকে মায়ানমারে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন রাজ্য সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: আভা, আরাকান, হানথাবতী প্রভৃতি। টউনগু সাম্রাজ্য প্রথম ১৫শ শতকে বার্মাকে একত্রীকরণ করে। ১৮শ শতকে ব্রিটিশরা বার্মা দখল করে নেয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬২ সালে দেশটিতে প্রথম সামরিক সরকার ক্ষমতায় অসীন হয়। খ্রীস্টিয় নবম শতকের পূর্বে কোনসময়ে বর্মীরা বর্তমান তিব্বত থেকে ইরাওয়াদি উপত্যকায় আসা শুরু করে। ৮৪৯ সালের মধ্যে তারা পাগানকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী রাজ্য গড়ে তোলে যা একসময় বর্তমান মায়ানমারের প্রায় সম্পূর্ণ এলাকাজুড়ে বিস্তার লাভ করে। ১১০০ সালের মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষাংশে কুবলাই খান পাগান রাজ্য দখল করেন। ১৩৬৪ সালে বর্মীরা রাজত্ব পুনরুদ্ধার করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিয়ানমারে জাপানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। রেঙ্গুন তথা বার্মা ১৯৪২-৪৫ পর্যন্ত সময়ে জাপানিদের দখলে ছিল। জাপানিদের তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়েছিল বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি। জাপানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন জেনারেল অং সান এবং বার্মা ইনডিপেনডেন্ট আর্মি।
বার্মা স্বাধীন হয়েছিল অং সানের মৃত্যুর পর। ১৯৪৮ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত বার্মা চারটি বহুদলীয় নির্বাচন দেখেছে কিন্তু অং সানের সঙ্গে সম্পাদিত তিন প্রধান উপজাতীয়দের সঙ্গে চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। উপরন্তু বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য অঞ্চলে, যার মধ্যে রোহিঙ্গা–অধ্যুষিত আরাকান, যার বর্তমান নাম রাখাইন অঞ্চলও যুক্ত হয়। ১৯৬২ সালের ২ মার্চ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে। সামরিক জান্তার প্রধান ছিলেন নে উইন। রেঙ্গুন নামটি ১৯৮৯ সালে সামরিক শাসকেরা পরিবর্তন করে রাখেন ইয়াঙ্গুন। নভেম্বর ২০০৫ সালে ইয়াঙ্গুন দেশের রাজধানীর মর্যাদা হারায়। বর্তমানে বার্মা বা মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে অত্যন্ত পরিকল্পিত নতুন শহর নেপিদতে। রাজনীতি সুদীর্ঘ সামরিক শাসনের ইতি ঘটিয়ে ২০১৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
মিয়ানমারের মোট আয়তন ৬৭৬,৫৫২ বর্গকিলোমিটার। উত্তর-দক্ষিণে এর দৈর্ঘ্য প্রায় ২,০৮৫ কিলোমিটার। পূর্ব-পশ্চিমে এর সর্বোচ্চ বিস্তার প্রায় ৯৩০ কিলোমিটার। উপকূলীয় এলাকাটি নিম্ন মিয়ানমার এবং অভ্যন্তরীণ অংশটি ঊর্ধ্ব মিয়ানমার নামে পরিচিত। অশ্বখুরাকৃতি পর্বতব্যবস্থা ও ইরাবতী নদীর উপত্যকা দেশটির ভূ-সংস্থানের প্রধান বৈশিষ্ট্য। উত্তরের পর্বতগুলির সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হকাকাবো রাজি-র উচ্চতা ৫,৮৮১ মিটার। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। আরও দুইটি পর্বতব্যবস্থা উত্তর থেকে দক্ষিণে বিস্তৃত।
আরাকান ইয়োমা পর্বতমালাটি মিয়ানমার ও ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে একটি প্রাচীরের সৃষ্টি করেছে। এর পর্বতগুলির উচ্চতা প্রধানত ৯১৫ মিটার থেকে ১,৫২৫ মিটার পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে শান মালভূমি থেকে বিলাউকতাউং পর্বতশ্রেণীটি প্রসারিত হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব নিম্ন মিয়ানমার এবং দক্ষিণ-পশ্চিম থাইল্যান্ডের সীমান্ত বরাবর চলে গেছে। শান মালভূমিটি চীন থেকে প্রসারিত হয়েছে এবং এর গড় উচ্চতা প্রায় ১,২১৫ মিটার।
মিয়ানমার আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে দুই গুণ বড়। দেশটির উপকূলের দৈর্ঘ্যও বাংলাদেশ থেকে পাঁচ গুণ বড়। প্রায় ২ হাজার ৮৩২ কিলোমিটার। কিন্তু জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্ধেকেরও কম। বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে প্রায় ৬৩ কিলোমিটার জলসীমা। বাকি ২০৮ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে দুর্গম পাহাড়ি অরণ্য ও বিচ্ছিন্ন জনপদ। এর সবটাই প্রতিবেশী দেশটির সাবেক আরাকান তথা বর্তমানের রাখাইন রাজ্য। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে তমব্রুর যোগবইন্যা থেকে থানচির বড় মোদক পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকা দুর্গম।
মিয়ানমার দেশটি প্রকৃতির অপরূপ এক নিদর্শন। অনেক প্রাচীন মন্দিরের রয়েছে হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ইতিহাস আর ঐতিহ্য। রূপ-বৈচিত্র্যের প্রাকৃতিক স্বর্গ মিয়ানমারের এসব জায়গা ঘুরে দেখতেই হয়, সেগুলোর মধ্যে যেগুলো খুবই বিখ্যাত, সেগুলোর তালিকা দেয়া হলো।
বেগান : ঐতিহাসিক বৌদ্ধমন্দির, প্যাগোডা আর প্রাকৃতিক সবুজে ঘেরা বেগান পর্যটন বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণ। এটি মিয়ানমারের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্পট। এখানে প্রায় ১৩ হাজারের বেশি বৌদ্ধমন্দির রয়েছে। এটি ৯ম থেকে ১৩ শতাব্দীর রাজাদের সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত। এটি সোনালি শহর হিসেবে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।
গোল্ডেন প্যালেস : এটি মান্দালয়ের ঐতিহাসিক বৌদ্ধবিহার। কথিত আছে, এখানে তত্কালীন মৃত রাজার আত্মা ঘুরে বেড়ায়। এটাকে রাজার ছেলে মূল রাজবাড়ী থেকে আলাদা করে। পরে এটিকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মশালায় পরিণত হয়। একসময় এটি সোনা দিয়ে ঘেরা ছিল কিন্তু বর্তমানে তা কেবল বিহারের ভিতরে সাজানো।
ম্রাউক উ : মিয়ানমারের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য হিসেবে এই শহরটি ব্যাপক আলোচিত। একসময় এই শহরটিকে ঘেরা দেয়ালের দুর্গ মনে করা হতো। বিশাল এ দেয়ালটি মূলত এখানকার প্রাচীন মন্দিরগুলোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্য তৈরি করা হয়।
তুয়াং কালাত : এটি মিয়ানমারের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। বিহারটি আগ্নেয়গিরির ঠিক মুখে অবস্থিত। এ বিহারটির মূল আকর্ষণ ৭৭৭টি সিঁড়ি। এ পাহাড়ের চূড়া থেকে আশপাশের প্রকৃতি অতুলনীয়।
শ্বেদাগন প্যাগোডা : এটাকে বৃহত্তম ড্রাগন প্যাগোডাও বলা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি অত্যন্ত পবিত্র স্থান। প্রাচীন ঐতিহ্যের অনেক নিদর্শন রয়েছে এখানে। রয়েছে গৌতম বুদ্ধের চুল ও বহু অমূল্য পাণ্ডুলিপি। নগেপালি : সাদা বালি আর বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশির নগেপালিকে সাজিয়েছে অপরূপ সৌন্দর্যে। অধিকাংশ পর্যটক এখানে মাছ ধরার জন্য আসেন।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর চরম নির্মমতা মিয়ানমারের প্রতি এখন আর কেউ সেরকম আকর্ষণ বোধ করেন না। সারা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ ঘৃণা পুষে রাখছে মিয়ানমারের বিপক্ষে। অথচ শান্তির দুত হিসেবে অং সাং সুচী কম জনপ্রিয় ছিলেন না। যাই হোক, যদি কখনও ওই দেশে শান্তি ফিরে আসে, তখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমিটি দেখে নেয়া যেতেই পারে।



No comments