Header Ads

মানবিক করিডর আসলে কী, বিশ্বের আর কোথায় আছে, কতটা কার্যকর || শাহরিয়ার সোহাগ


মানবিক করিডর আসলে কী, বিশ্বের আর কোথায় আছে, কতটা কার্যকর, Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, romantic bangla poem, bangla poem for love, small bangla poe

মিয়ানমারের রাখাইনের রোহিঙ্গাদের জন্য শর্ত পূরণ সাপেক্ষে একটি হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বা মানবিক করিডর দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে; বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন এই তথ্য প্রকাশের পর মানবিক করিডর ইস্যুটি নিয়ে দেশে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক হচ্ছে। করিডর বিষয়ে সরকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যাখ্যা দাবি করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।

প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে, সরকার তথাকথিত 'মানবিক করিডর' নিয়ে জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি। "রাখাইন রাজ্যে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সাহায্য দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে রাজি হবে–– এটাই আমাদের অবস্থান," বলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে যে মানবিক করিডর বা হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ বলতে আসলে কী বোঝায়? এটি কীভাবে কাজ করে? কীভাবে ও কেন কোনো দেশে এ ধরনের করিডর প্রতিষ্ঠা করা হয়?

প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক সময়ে ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ নৃশংসতায় তীব্র মানবিক সংকটে পড়া গাজার মানুষদের জন্য সহায়তা পাঠাতে মানবিক করিডর বারবার আলোচনায় এসেছে।

যদিও বাংলাদেশে এটি আলোচনায় এসেছে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর প্রসঙ্গে। এর বাইরে বিশ্বের নানা দেশে সংঘাতময় এলাকায় এ ধরনের করিডর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ দেখা গেছে।


মানবিক করিডর কী ?

বিশ্বের সংঘাতময় অঞ্চলগুলোয় যেখানে মানুষ খাদ্য ও ঔষধসহ জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী পায় না কিংবা বেসামরিক নাগরিকসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেখানে মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।

আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে আইনের আওতায় যাদের সরাসরি সহযোগিতা করা যায় না তাদের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বিশ্বের যেসব জায়গায় এমন মানবিক করিডর হয়েছে তার কোনো কোনোটি বিবদমান পক্ষগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনার মাধ্যমে, আবার কোনোটি তৃতীয় পক্ষ- বিশেষ করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর যখন কোনো উপায় থাকে না, তখন একটি স্বীকৃত পথ বা প্যাসেজের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। তবে করিডর মানেই যে জলভাগ বা স্থলভাগ হবে এমন নয় বরং এটি সময় নির্ধারণ করেও হতে পারে। সংঘাতময় এলাকায় মানবিক সহায়তা পাঠানোর এমন পথ বা পদ্ধতিই মানবিক করিডর।

মূলত জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন রেজুলেশন (৪৬/১৮২ এবং ৫৮/১১৪) এ মানবিক নীতিকে অনুমোদন করা হয়েছিলো। সংস্থাটি মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রের সব কার্যক্রম গাইড করে থাকে। সহায়তা বলতে –– যুদ্ধ, জলবায়ু বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যাদের মৌলিক অধিকার বিঘ্নিত তাদের জীবন রক্ষাকারী সহায়তার কথা বলা হচ্ছে। তবে এই মানবিক সহায়তা অবশ্যই হতে হবে মানবিকতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায্যতার নীতি অনুসারে।

আর নিরাপদ মানবিক করিডরের অর্থের সংজ্ঞায় সংস্থাটি বলেছে–– জরুরি সরবরাহের জন্য একটি প্যাসেজ। এমন একটি মানবিক করিডরের মধ্য দিয়ে ত্রাণসামগ্রী মুক্তভাবে সংঘাতময় এলাকায় যেতে পারে। জাতিসংঘের সনদ অনুসারে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সম্মতিতে মানবিক সহায়তা দেওয়া উচিত। এটি হবে একটি অসামরিক জোন, একটি নির্দিষ্ট এলাকা এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলো তাতে সম্মত হতে হবে। আর রেডক্রস মানবিক করিডরের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত পক্ষগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুমোদন করা নিরাপদ প্যাসেজ। বেসামরিক নাগরিকদের সংঘাতময় এলাকা ত্যাগ করা, মানবিক সহায়তা সামগ্রী আনা বা নেয়া কিংবা আহত, অসুস্থ বা নিহতদের সরানোর জন্য এটি ব্যবহার করার অনুমোদন তারা দিতে পারে। গত কয়েক দশকে মানবিক করিডর লাখ লাখ মানুষের জীবন রক্ষা করেছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সম্মতিতেই একটি করিডোরে প্রবেশাধিকার ও এর সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।

তবে অনেক ক্ষেত্রে বিবদমান পক্ষগুলোকে রাজি করাতে না পারলে জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অনেক সময় এমন প্যাসেজ বানায়, যেখানে বিবদমান সব পক্ষকে সরিয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা দেয়া হয়।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বীর শহিদ ও অকুতোভয় আন্দোলনকারীদের স্মরণে ও সম্মানে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস বাংলা বসন্ত। অর্ডার করতে ক্লিক করুন

মানবিক করিডরের ঝুঁকি কতটা ?

অনেক জায়গায় নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন হয়নি এমন জায়গায় বিবদমান কোনো কোনো পক্ষ এই প্যাসেজে আক্রমণ করার নজির আছে। এমনকি অনেক জায়গায় মানবিক করিডরে হামলায় সিভিলিয়ানের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আবার কোনো জায়গায় এমন করিডরে থাকা সেতু উড়িয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে এমন করিডরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আবার অস্ত্র পাচার এবং দখলকরা এলাকায় জ্বালানি চোরাচালানের জন্যও এই করিডর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ধরনের করিডরের সুরক্ষা ও প্রবেশাধিকার অনেকটা সীমিত থাকে। যে এলাকায় সংঘাত হয় সেখানে নির্দিষ্ট মানবিক করিডরে নিরাপদে পৌঁছানোও ত্রাণকর্মী ও বেসামরিক নাগরিকদের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। এ ধরনের করিডরের উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত থাকা উচিত। অর্থাৎ এটা কি ত্রাণসামগ্রী বা জরুরি সহায়তার জন্য, নাকি বেসামরিক নাগরিকদের সংঘাতময় এলাকা ত্যাগের জন্য, নাকি উভয় উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হবে সেটার পরিষ্কার ঘোষণা থাকা উচিত। করিডরটি হতে হবে নিরাপদ, প্রবেশযোগ্য ও কার্যকর। সব পক্ষের মধ্যেই বিস্তারিত সমঝোতা হতে হবে।


আরও পড়ুন মিয়ানমারকে ঘিরে আসলেই কি কোনো 'প্রক্সি ওয়ার' চলছে ?


মানবিক করিডর কি নতুন কিছু ?

এটি নতুন কিছু নয়। বরং বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সংঘাতময় অঞ্চলগুলোতে মানবিক করিডরের প্রচলন শুরু হয়। নাৎসি নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো থেকে ১৯৩৮-৩৯ সালে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো।

নিরাপত্তা পরিষদের নেয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে বসনিয়ার সারায়েভোতে ১৯৯২-৯৫ সালে এবং ২০১৮ সালে সিরিয়ার ঘৌতা থেকে বেসামরিক লোকজনকে সরিয়ে আনার জন্য মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো।

প্রথম আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধের (নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধ) সময় ১৯৮৯ সালে লাচিন করিডোর স্থাপিত হলেও সেটি দুই বছরের মধ্যেই বন্ধ করে দিয়েছিলো আজারবাইজান সরকার।

আবার ১৯৯৩ সালে নিরাপত্তা পরিষদের এক প্রস্তাবের মাধ্যমে সেব্রেনিৎসা ছিটমহলকে নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ওই বছরেই আরেক প্রস্তাবের মাধ্যমে সারায়েভো, জেপা, গোরাজদে, তুজলা ও বিহাচকেও এর অন্তর্ভুক্ত করে মোট ছয়টি মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো।

কিন্তু নিরাপদ এলাকাগুলোকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা হবে তার কোনো রূপরেখা ছিল না। ফলে পরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ১৯৯৫ সাল নাগাদ সেব্রেনিৎসায় গণহত্যার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এটি ইউরোপের ভয়াবহ নৃশংসতার একটি।


আবার অনেক জায়গায় এ ধরনের মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ইয়েমেনের চলমান যুদ্ধের মধ্যে বারবার এমন করিডরের আহ্বান জানিয়েও সফল হয়নি জাতিসংঘ।

আফ্রিকার কঙ্গোয় ২০০৮ সালে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং জেনারেল লরেন্ট নকুন্ডার নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করলে জাতিসংঘের প্রস্তাবে গোমা অঞ্চলে একটি মানবিক করিডোর খোলার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত সামরিক নানা বিষয়ে জড়িয়ে সংকটে পড়ে যায়।

জাতিসংঘ নিজেও অনেক সময় অসহায় থাকে। বৃহৎ শক্তিগুলো যা চায় তার বাইরে যাওয়ার সামর্থ্য তার থাকে না। যে কারণে অনেক জায়গায় মানবিক করিডর প্রয়োজন হলেও করা যায়নি। আবার অনেক জায়গায় করিডর হলেও সেটি টেকসই ও কার্যকর হয়নি।

আবার ইথিওপিয়ায় টাইগ্রে অঞ্চলে বহু মানুষ মাসের পর মাস সরকারি অবরোধে আটকে পড়লে ২০২২ সালের নভেম্বরে মানবিক করিডোরগুলো পুনরায় চালুর মধ্য দিয়ে তাদের প্রাণে বাঁচানো সম্ভব হয়।

মানবিক করিডরের সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। যে অঞ্চলে মানবিক করিডর হবে সেখানকার বিবদমান পক্ষ একমত হলে করিডর পরিচালনা সহজ হয়। কিন্তু সবাই রাজি না হলে তা হয় কঠিন।



মানবিক করিডর জটিলতার উদাহরণ

২০২২ সালের মার্চে ইউক্রেন ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা একটি মানবিক করিডরের বিষয়ে সম্মত হয়েছিলেন যার লক্ষ্য ছিল সংঘাতময় এলাকা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যেতে সহায়তা করা।

কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেলো মানবিক করিডরের সংখ্যা ছিল সীমিত। আবার কোন সময় কোন করিডর ব্যবহার করা যাবে এমন তথ্যগুলোও আসছিলো শেষ সময়ে। ফলে বেসামরিক নাগরিকদের তা ব্যবহার করার সুযোগ কম ছিল।

বরং করিডর ব্যবহারের সময় বিশেষ করে দোনেৎস্ক ও লুহানস্কে বেসামরিক মানুষ চেকপোস্টগুলোতে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। তাছাড়া কারা এই করিডরের অনুমতি দেবে তা নিয়েও সংকট তৈরি হয়েছিলো।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষকে করিডর ব্যবহার করে নিরাপদ এলাকার দিকে যাওয়ার জন্য কয়েকদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিলো। এমনকি এমন মানুষদের বহনকারী একটি কনভয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা পর্যন্ত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.