গাদ্দাফির পতনের পর সমৃদ্ধ লিবিয়া এখন ‘ধ্বংসস্তুপ’ || শাহরিয়ার সোহাগ
উত্তর আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল লিবিয়া। ১৯৬৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে লিবিয়ার ক্ষমতায় এসেছিলেন কর্নেল মুয়াম্মর গাদ্দাফি। মাত্র ২৭ বছর বয়সে গাদ্দাফি যখন লিবিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করেন, তখন লিবীয়রা ছিল পুরোদস্তুর যাযাবর জাতি, তাদের আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে তেমন ধারণাই ছিল না। দেশের সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য নানাভাবে ছিল পশ্চিমাদের দখলে। বিপুল সম্পদ থাকা সত্ত্বেও জনগণ ছিল দরিদ্র।
উন্নত বিশ্ব থেকে পিছিয়ে থাকা দেশকে গাদ্দাফি একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন। দেশের মানুষের জন্য এনে ছিলেন বিপুল সুযোগ-সুবিধা ও উন্নয়ন। তবে ২০১১ সালে তার ক্ষমতাচ্যুতের পর দেশটি সমৃদ্ধ অর্থনীতি থেকে ব্যর্থ একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনামলে তাকে ঘিরে রয়েছে সমালোচনা, ভালোবাসা, আক্ষেপ, ঘৃণা। কীভাবে তাকে হত্যা করা হয়, কেমন ছিল তার শাসনব্যবস্থা, গাদ্দাফির পতন ঘটিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব কী চেয়েছিল, লিবিয়া কী পেল-এমন অনেক প্রশ্ন রয়েছে আজও। কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলেছে, কিছু মেলেনি।
যেভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে গাদ্দাফি
১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর দেশটির সেনাবাহিনীর তৎকালীন ক্যাপ্টেন গাদ্দাফি এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাদশাহ ইদ্রিসকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। লিবিয়াকে রাজতন্ত্রমুক্ত করে দেশটিকে একটি প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে নিজেকে ক্যাপ্টেন থেকে কর্নেল পদে উন্নীত করেন।
কেমন ছিল গাদ্দাফির শাসন
গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিরোধীদের দমন-পীড়নের অভিযোগ ছিল। তবে তার আমলে লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা ছিল। আফ্রিকা তো বটেই, এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে লিবিয়া ছিল লোভনীয় কর্মক্ষেত্র। দেশটিতে গিয়ে তারা বিপুল অর্থ আয় করেছেন। জীবনমানের উন্নয়ন করেছেন।
গাদ্দাফি দেশের তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন। তার সময়ে লিবিয়া অনেক বেশি তেলসমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়। প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য লিবিয়ার ১১টি সীমান্ত এলাকাকে ৪টি জোনে ভাগ করে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় দেশকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করার কাজ করেছিলেন। ৪২ বছরের শাসনে দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
তার শাসনামলে প্রত্যেক লিবীয়কে বাড়ি বরাদ্দ দিত গাদ্দাফি প্রশাসন। বিনামূল্যে ছিল শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা। এমনকি চিকিৎসা সেবার জন্য বাইরের দেশে প্রেরণের খরচ সরকারের পক্ষ থেকে বহন করা হতো। ব্যবসায়ের জন্য নাগরিকদের সরকারের পক্ষ থেকে খামার, গবাদিপশু ও বীজ সরবরাহের ব্যবস্থা করে গাদ্দাফি প্রশাসন। বিদ্যুতের জন্য নাগরিকদের কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হতো না।
পশ্চিমাদের সঙ্গে বিরোধ
শুরু থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের চক্ষুশূল ছিলেন গাদ্দাফি। তিনি চাইতেন আরব আধিপত্য। ১৯৭২ সালে ফেডারেশন অব আরব রিপাবলিকস গঠনের মাধ্যমে আরব দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। তবে এ উদ্যোগ সফল হয়নি। আউজো উপত্যকা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ চাদের সঙ্গে সত্তর দশকে যুদ্ধে জড়ায় লিবিয়া। গাদ্দাফি সব সময়ই ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিলেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে সমর্থন দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর রোষের শিকার হন তিনি।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান গাদ্দাফিকে “মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর” বলতেন। ১৯৮২ সালের মার্চে লিবিয়ার তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। লিবিয়ার তেলশিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ২০০৪ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়। এ সময়ে লিবিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২০০৯ সালে গাদ্দাফি আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আফ্রিকার দেশের স্বার্থ নিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে গাদ্দাফির ঝাঁজালো বক্তব্য, নীতিমালার অনুলিপি ছিঁড়ে ফেলা পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কে আবারও অবনতি ঘটায়। এসবেরই প্রভাব পড়তে থাকে গাদ্দাফির নিজের সাম্রাজ্যে।
গাদ্দাফিকে হত্যা
২০১০ সালের শুরুর দিকে বিশ্ব আন্দোলিত হয় আরব বসন্তের ঢেউয়ে। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিউনিসিয়া, মিসরের প্রতিবেশী দেশগুলোতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলে। তিউনিসিয়ায় জাইন আল-আবিদিন বেন আলী ও মিসরে হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। এ সময়েই বেনগাজি শহরে ছড়িয়ে পড়ে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ। বিক্ষোভ দমনে গাদ্দাফি বেছে নেন সহিংস উপায়। গোলাবারুদ, যুদ্ধবিমান দিয়ে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেন। গাদ্দাফি সরকারের অনেক মন্ত্রী এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করেন।
২০১১ সালের আগস্টে বিদ্রোহী বাহিনী ত্রিপোলিতে ঢুকে পড়ে। শহরের বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। ২৩ আগস্ট তারা ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির সদর দপ্তর আল-আজিজিয়া কম্পাউন্ড দখল করে। শুরু হয় গাদ্দাফির খোঁজ। গাদ্দাফি বাহিনীও প্রতিরোধ চালাতে থাকে।
রাজধানী ত্রিপোলির পতনের পর, সিয়ার্ত শহরে গাদ্দাফির অনুগত বাহিনী শেষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই শহরেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়
গাদ্দাফি পরবর্তী লিবিয়া
গাদ্দাফির পতন তো হলো। পশ্চিমাদের চাওয়াও পূর্ণ হয়েছিল। তবে গাদ্দাফিকে হত্যার পর এক দশকেও লিবিয়ায় কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও গণতন্ত্র ফেরেনি। বরং বেড়ে যায় অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তাহীনতা। লিবিয়ার সমৃদ্ধ অর্থনীতি এখন অনেকটাই বেহাল।
গাদ্দাফি-পরবর্তী এক দশকে ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। ধ্বংস করেছে অবকাঠামো। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার অর্থনীতি ধীরে ধীরে পতনের দিকে গেছে। পশ্চিমাদের মোহভঙ্গের পর লিবিয়ায় শান্তি ফেরাতে উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ। অবশেষে ২০২০ সালের অক্টোবরে সফলতা মেলে। অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে দেশটিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংঘাত থামে, খুলে যায় শান্তি আলোচনার পথ।
গাদ্দাফিকে হত্যার এক দশক পরে এসেও লিবিয়ার অনেক মানুষ গাদ্দাফি ও তার শাসনামলের কথা মনে রেখেছেন। দেশটির বনি ওয়ালিদ শহরের প্রবেশমুখে তার একটি বিশাল প্রতিকৃতি রয়েছে। সেখানকার ওয়ারফারা সম্প্রদায়ের মানুষ গাদ্দাফি ও তার পরিবারকে মনে রেখেছেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত এএফপির এক খবরে সেখানকার বাসিন্দা মোহাম্মদ দাইরিকে বলতে শোনা যায়, “গাদ্দাফি আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন। আমরা সব সময় তার দেখানো পথেই চলব।”



No comments