Header Ads

রাজনীতিতে জুলাইয়ের ছাপ কোথায় || শাহরিয়ার সোহাগ

রাজনীতিতে জুলাইয়ের ছাপ কোথায়, ঢাকা ভয়েস, Dhaka Voice, Trending News, Viral News, Top News, Hot News, bangla news, bangladesh,

আন্দোলনের শক্তিগুলো ক্রমে আবারও পুরোনো ধাঁচের স্বতন্ত্র ‘রাজনৈতিক দল’ হয়ে গেছে এবং আসন্ন নির্বাচন কেবল পুরোনো ‘রাজনৈতিক দলগুলোর জয়-পরাজয়’-এর ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। অথচ এটা হওয়া দরকার ছিল অভ্যুত্থান-উত্তর ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ গঠনের নির্বাচন

ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান এক বছর অতিক্রম করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারও ১২ মাস পার করল। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নির্বাচন এবং আরেকটি সরকার পাওয়ার আয়োজন। কিন্তু গত এক বছরে বাংলাদেশের অর্জন কী– এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি। বিশেষ করে আমাদের রাজনীতিতে, রাজনৈতিক দলগুলোর লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-কাজে গণঅভ্যুত্থানের কতটা ছাপ পড়ল? ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আকাঙ্ক্ষায় কতটা শামিল হতে পারছেন রাজনীতিবিদরা? গণঅভ্যুত্থানের সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে পরিবর্তনের রাস্তায় কতটা টেনে আনতে ও জড়ো করে রাখতে পারল? 

নির্বাচনোত্তর ভবিষ্যতের জন্য এই প্রশ্নগুলো নিয়ে এখনই ভাবনা ও পুনর্ভাবনা দরকার। চব্বিশের ‘৩৬ জুলাই’ কেবল আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত একটা সরকার উৎখাত করতে চায়নি– গত পাঁচ দশক ধরে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থারও অপসারণ চেয়েছিল। ব্যাপক চ্যালেঞ্জিং সেই দায়িত্ব নিতে এই সময়ের রাজনীতিবিদরা কি আদৌ প্রস্তুত? তার জন্য যে আত্মজিজ্ঞাসা এবং অভ্যাস ও আচরণের যে আমূল সংশোধন দরকার, সেটি কি ঘটছে? কোথায় সেসব লক্ষণ?


কেন আসন্ন নির্বাচন একটা সাধারণ নির্বাচন নয়

নির্বাচনের মূল চরিত্র অবশ্যই প্রাপ্তবয়স্ক জনতা। নির্বাচন যত অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে তত ছাত্র-শ্রমিক-জনতা নায়ক হয়ে উঠবে। ১৯৫৪, ১৯৭০, ১৯৯১ ও ১৯৯৬-এ কমবেশি সে রকম ঘটেছিল এই দেশে। এবারও সে রকম নির্বাচন চাইছে মানুষ। 

যে দেশে প্রায় দেড় দশক কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না, সেখানে চুয়ান্ন ও সত্তরের মতো একটা নির্বাচনই বড় এক রাজনৈতিক সংস্কার। তাই আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের কাছে যে কোনো ভোট উৎসবের চেয়েও বেশি কিছু। বিগত ঐতিহ্যের সেরা চারটি নির্বাচনের চেয়েও আগামী ফেব্রুয়ারির আগে-পরে বাংলাদেশ আরও বেশি কিছু পেতে চায়। যে রাজনীতি এটি বুঝতে অক্ষম, সে কীভাবে বাংলাদেশকে পথ দেখাবে?

এখনকার অবস্থা ও আকাঙ্ক্ষাকে আমরা কিছুটা ১৯৭০-এর নির্বাচনকালের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে পারি। সেই সময় মানুষ তার জাতিগত বঞ্চনার কাঠামোগত সমাধান চাইছিল। সেই চাওয়া এত প্রবল ছিল যে, তা শেষমেশ ‘ছয় দফা’কেও অতিক্রম করে যায়। মানুষের রাজনৈতিক প্রত্যাশার তীব্রতা সে সময় ছয় দফার প্রতিপক্ষ যেমন বুঝতে পারেনি, তেমনি পক্ষের শক্তিরও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি ছিল না তাকে ধারণ করার। এখনকার বাংলাদেশও ভিন্নভাবে প্রায় কাছাকাছি একটা মুহূর্ত পার করছে। 

গণঅভ্যুত্থানের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনকালে অনেকের মাঝে স্মৃতিচারণের মনোভাব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ‘চব্বিশ’-এর ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ‘৩৬ জুলাই’কে চলমান গণ্য করাই শ্রেয়। নির্বাচনের ভেতর দিয়েও সেই কাফেলা জীবন্ত এগোতে থাকবে। আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে নতুন সরকার গঠিত হলেও ‘চব্বিশ’ থামবে না, যতদিন না রাজনীতিবিদরা নতুন ধরনের একটা ‘২৬ মার্চ’-এর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। এই প্রস্তুতি হতে হবে সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক, আদর্শিক ও কর্মসূচিগত এবং সেটি হবে নিজেদের পরিবর্তন করার যুদ্ধ।

চব্বিশের আগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর যেসব গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র ছিল এবং সেই আলোকে যে ধরনের চর্চা ছিল, ‘৩৬ জুলাই’য়ের পর তার আমূল বদল দরকার। ১৯৭১-এর ৯ মাস বাংলাদেশে প্রায় একই রকম একটা রাজনৈতিক চাহিদা তৈরি করে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পরের বাংলাদেশের রাজনীতি সেই চাহিদার গভীরতা উপলব্ধিতে নিতে পারেনি। ১৯৭২-এর বাংলাদেশ বৈষম্য উৎপাদক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং কর্নওয়ালিসের সাজানো প্রশাসন দিয়ে আর শাসিত হতে চায়নি। তখনকার আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ সময়ের সেই চাহিদাকে পথ করে দিতে অসফল ছিল। মুজিব সরকার জনতার যৌথ ইচ্ছাকে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জাতীয় সরকার গড়তে ব্যর্থ হয়।

এবারও অন্তর্বর্তী সরকার জনতার যৌথ-সাধারণ-ইচ্ছার বাস্তবায়নে একটা সম্মিলিত পাটাতন হয়ে উঠতে পারল না। একটা দল ও তার সংগঠকদের প্রতি সচেতন কিংবা অবচেতন পক্ষপাত দেখাতে গিয়ে তারা আন্দোলনের অন্যান্য শক্তিকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়েছে। ‘আন্দোলনের শক্তি’গুলো এভাবে ক্রমে ক্রমে আবারও পুরোনো ধাঁচের স্বতন্ত্র ‘রাজনৈতিক দল’ হয়ে গেছে এবং আসন্ন নির্বাচন সেই অর্থে কেবল পুরোনো ‘রাজনৈতিক দলগুলোর জয়-পরাজয়’-এর ব্যাপার হয়ে উঠতে পারে। অথচ এটি হওয়া দরকার ছিল অভ্যুত্থান-উত্তর ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ গঠনের নির্বাচন। যেভাবে ’৭১-এর পরের ‘বাংলাদেশ’ আরেকটি পাকিস্তান বা ভারত হওয়ার কথা ছিল না। বরং তার মাঝে তখন সম্পূর্ণরূপে ঔপনিবেশিক আইনকানুন-সংস্কৃতি থেকে মুক্ত নতুন একটা জনপদ হওয়ার আকুতি ছিল। যে জনপদ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য নিপীড়িত জাতিকে ‘মুক্তি’র পথ দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু গত ৫৪ বছর যেন কর্নওয়ালিসই বাংলাদেশ শাসন করে গেলেন। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর কি নতুন আরেক দল কর্নওয়ালিস চাইছে বাংলাদেশ?

                        ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বীর শহিদ ও অকুতোভয় আন্দোলনকারীদের স্মরণে ও সম্মানে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস বাংলা বসন্ত। অর্ডার করতে ক্লিক করুন

রাজনৈতিক দলগুলো যেভাবে আত্মঘাতী ফাঁদে

চব্বিশের গণযাত্রার এক বছর পর সে সময়কার হত্যাকাণ্ডগুলোর নানান কারিগরি প্রতিবেদন ও ডকুমেন্টারি জনসমক্ষে আসছে এখন। সেসব দেখলে-পড়লে চোখ জলে ভেসে যায়। খেয়াল করলে আমরা দেখব, শহীদদের তালিকায় কেন্দ্রীয় রাজনীতিবিদরা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নেতাও কম। তার মানে এই নয়, চব্বিশের গণযাত্রায় তাদের অবদান কম। বরং ‘৩৬ জুলাই’য়ের আগের দেড় দশক কিংবা তারও বহু আগে থেকে রাজনৈতিক কর্মীরা একটা নতুন বাংলাদেশের জন্য শ্রম-ঘাম-রক্ত দিয়ে চলেছেন। কিন্তু চব্বিশ মূলত অতি সাধারণ খেটে খাওয়া গরিবদের রক্তস্নান। সে জন্যই গরিব ছাত্র-শ্রমিকের যাত্রাবাড়ী ছিল চব্বিশের লেনিনগ্রাদ। কিন্তু গত ১২ মাসে শ্রমজীবীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো একাত্ম হলো কতটা? সরকার একটা শ্রম কমিশন করলেও তার সুপারিশগুলো ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার টেবিলে আনেনি। রাজনৈতিক দলগুলো সেসব বিষয়ে তাগাদা দিয়েছে, এমন কিছু দেখা যায়নি। কোনো রাজনৈতিক দল তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নতুন করে শ্রমজীবী সমাজের প্রতিনিধি বাড়াল কি? যাত্রাবাড়ী, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়ার শ্রমজীবীদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র প্রশ্নে সংলাপে বসল কি? নাকি সেসব এলাকার পুরোনো এলিট নেতাদেরই মনোনয়ন দিয়ে জনপ্রতিনিধি বানিয়ে আনা হবে? 

নারীদের সরাসরি নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ বিষয়েও রাজনৈতিক দলগুলো অভ্যুত্থানের চাওয়ার আলোকে কোনো অগ্রসর অবস্থান নিতে পারেনি। সরকারকে চাপে ফেলতে পারেনি। জনতাকে নতুন করে সংগঠিত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার টেবিলে এসব বিষয়ের জোরালো দাবি প্রতিষ্ঠিত করেনি। সরকারও কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের পুরোনো ধরনে মজা পেয়ে থাকবে হয়তো। সে কারণে মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে তৈরি প্রশাসনিক সংস্কার বা একই সময়ে তৈরি পুলিশ সংস্কার কমিশনের মৌলিক ধাঁচের প্রস্তাবগুলো স্রেফ আলোচনার পরিমণ্ডল থেকে আলাদা করে রাখা হলো। 

শিক্ষা ও কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি পরিসরে সংস্কার বলতে কিছুই হয়নি। হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ এবং সংসদের স্থায়ী কমিটির কয়েকটিতে সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার বাইরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দীর্ঘ সংলাপ পর্ব থেকে বড় কোনো অর্জন নেই। তারপরও রাজনৈতিক দলগুলোকে বেশ সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে। কারণ তারা নির্বাচনের তারিখ পেয়েছে। লীগবিরোধী একটা ‘জুলাই-ঘোষণা’ও পেয়েছে। অথচ লীগের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রও পুরোদস্তুর আছে।

স্পষ্টই মনে হচ্ছে, সরকারের পাশাপাশি প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল মোটামুটি সব পুরোনো ব্যবস্থা রেখে দেওয়ার পক্ষে। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সব পরিসর বড় দলগুলো সংস্কারহীন রেখে দিতে তৎপর। অধিকাংশ দল গত এক বছরে তাদের নেতৃত্ব কাঠামোতেও মোটা দাগে কোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটায়নি। 

ক্ষমতা কাঠামোর এ রকম ‘স্থিতিশীলতা’ আমলাতন্ত্রেরও ভারি পছন্দ। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বড় বড় রাজনৈতিক দলের এই মৈত্রীর জায়গা ‘৩৬ জুলাই’য়ের পরের দিন থেকে একটু একটু করে আমাদের এমন এক বাস্তবতায় এনে দাঁড় করাল, যেখানে সংগত কারণেই এক বছর আগের উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ আর নেই।

এর পাশাপাশি গত ১২ মাস ধরে সংখ্যালঘু অঞ্চলগুলোতে যে বিপুল অনাচার হলো, যেভাবে বেনামি মামলা এবং নানান কায়দায় মব-সহিংসতা হলো, তাকে সরকার বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো কেউ শক্তভাবে রুখে দাঁড়ায়নি। তারা এসব থামাতে চেয়েছে বলেও মনে হয়নি। 

আসন্ন ফেব্রুয়ারি-মার্চে এই দুই মিলিত শক্তির শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর পর্ব দেখব আমরা। কিন্তু চব্বিশের শক্তিজোটে এই দুই পক্ষের বাইরের মানুষই বেশি ছিল। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ নিশ্চয় ভোট দেবে, কিন্তু তারা নীরব প্রতিপক্ষ হিসেবে রাজনীতিবিদদের দিকে তীক্ষ্ণ নজরও রাখবে। সেই সূত্রে বলা যায়, সংস্কারহীন নির্বাচন রাজনীতিবিদদের জন্য একটা আত্মঘাতী ফাঁদ। যে ফাঁদ তারা নিজেরাই তৈরি করছেন। নিজেরাই সেখানে প্রবেশ করছেন। 

সংস্কার প্রশ্নকে ভবিষ্যতের হাতে সঁপে দেওয়ার একটা ‘জুলাই ঘোষণা’ অনাগত দিনের বাংলাদেশে পরবর্তী গণঅসন্তোষ কতটা রুখতে সক্ষম হবে, সেটি এখনই বলা মুশকিল। সেই অধ্যায়ের সময়সূচি আমরা জানি না। আমরা এও জানি না, সদ্য প্রচারিত ‘জুলাই ঘোষণা’ তৈরিতে শ্রমিকরা, নারীরা, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কিংবা এ রকম অন্যান্য আন্দোলনের শক্তি কীভাবে অংশ নিয়েছেন। কীভাবে এতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া সব পক্ষের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো হলো?

No comments

Powered by Blogger.