২০ দস্যু বাহিনীর দাপটে অস্থির সুন্দরবন
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বনদস্যুরা। বন বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বল নজরদারির সুযোগে নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে অন্তত ২০টি দস্যু বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। বনজীবী ও জেলেদের অপহরণ করে নিয়মিত মুক্তিপণ আদায়, নৌকা ও মালামাল লুট, অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে মাছধরা নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে সুন্দরবন আবারও আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। দুলাভাই বাহিনীসহ সক্রিয় বাহিনীর সংখ্যা বাড়ায় দীর্ঘ ছয় বছর পর সুন্দরবন ফের দস্যুর দখলে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
মুক্তিপণ দিয়ে বনে ফেরা জেলে ও উদ্ধার হওয়া বনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আত্মসমর্পণকারী আগের অনেক দস্যুই আবারও অপরাধ জগতে ফিরে এসেছে। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আত্মসমর্পণকারী ৩২টি বাহিনীর বহু সদস্য পুনরায় সক্রিয় হয়েছে। একই সঙ্গে নতুন নতুন বাহিনীও গড়ে উঠছে। সুন্দরবনের জেলে, মৌয়াল ও বাওয়ালিদের ভাষ্যমতে, এখন অন্তত ২০টি বাহিনীর দাপটে তাদের জীবন-জীবিকা চরম হুমকির মুখে।
২০১৮ সালের ১ নভেম্বর সরকার সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করেছিল। ২০১৬-১৮ সালের মধ্যে ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ সদস্য আত্মসমর্পণ করে ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গুলি জমা দেয়। দীর্ঘদিন শান্ত থাকা সুন্দরবনে পুনরায় অস্থিরতা দেখা দেয় ২০২৪ সালের আগস্টের পর। রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ও নজরদারির দুর্বলতায় দুলাভাই বাহিনীসহ বিভিন্ন দল পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে।
দুলাভাই বাহিনীর জন্ম হয় ইলিয়াস বাহিনীর প্রধান ইলিয়াসের মৃত্যুর পর। ইলিয়াসের বোনের স্বামী রবিউল নতুন বাহিনী গঠন করলে স্থানীয়ভাবে এটিকে বলা হয় ‘দুলাভাই বাহিনী’। বর্তমানে এই বাহিনীসহ আরও ২০টির বেশি বাহিনী সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় দাপট চালাচ্ছে। বনজীবীদের মতে, আত্মসমর্পণকারীদের অন্তত ১৩ জন আবারও দস্যুতা শুরু করেছেন।
জেলেদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন সক্রিয় বাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে—
আসাবুর বাহিনী, করিম শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী, রবি বাহিনী, দুলাভাই বাহিনী, রাঙ্গা বাহিনী, সুমন বাহিনী, আনারুল বাহিনী, হান্নান বাহিনী, আলিফ বাহিনী, জাহাঙ্গীর বাহিনী, দাদাভাই বাহিনী, ইলিয়াস বাহিনী ও মজনু বাহিনী—এ ছাড়া আরও চার-পাঁচটি নতুন দল রয়েছে। প্রতিটি বাহিনীতে ১৫-২০ জন থেকে শুরু করে ৪০ জন পর্যন্ত অস্ত্রধারী সদস্য রয়েছে। দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, ধারালো অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এসব বাহিনী বনের গভীর অঞ্চলে আস্তানা গড়ে তোলে।
জাহাঙ্গীর বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী ও দাদাভাই বাহিনী বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী ও দুর্ধর্ষ হিসেবে পরিচিত। তাদের হাতে বেশি অস্ত্র এবং আগের আত্মসমর্পণকারী সদস্য থাকায় সংগঠনগুলো আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে।
গত এক বছরে এসব বাহিনীর হাতে কমপক্ষে তিন শতাধিক জেলে, মৌয়াল ও বাওয়ালি অপহরণের শিকার হয়েছে। শুধু গত তিন মাসেই শতাধিক জেলেকে জিম্মি করা হয়েছে। তাদের পরিবার ও মহাজনের কাছ থেকে বিকাশ ও বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে মুক্তিপণের টাকা আদায় করা হয়। বর্তমানে ১৫ থেকে ২০ জন জেলে এখনো কয়েকটি বাহিনীর কাছে জিম্মি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বনজীবীরা।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা, চাঁদপাই রেঞ্জ এবং মরাভোলা, আলীবান্দা, ধনচেবাড়িয়া, দুধমুখী, শ্যালা, নারকেলবাড়িয়া, টিয়ারচর, পশুর, আন্দারমানিক, শিবসা—এসব এলাকাতেই দস্যুদের আনাগোনা সবচেয়ে বেশি। জেলেরা জানান, বনে গেলে নৌকা প্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর অপহরণ হলে দিতে হয় ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত।
বন সংলগ্ন এলাকায় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি দস্যুদের গডফাদার, মহাজন, মধ্যস্থতাকারী ও সোর্স হিসেবে কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের টাকা পৌঁছে দেয় বাহিনীর কাছে। জেলেদের নৌকায় বাহিনীর দেওয়া গোপন সংকেতসংবলিত টোকেন থাকলে তারা নিরাপদে মাছ ধরতে পারে।
জেলেদের অভিযোগ, এসব গডফাদার ও সোর্স দস্যুদের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ রাখে না। তথ্য ফাঁস হলে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ে, মুক্তিপণের অর্থও বাড়িয়ে দেয় তারা।
আত্মসমর্পণকারী জাহাঙ্গীর শেখ, জয়নাল আবেদীন ওরফে রাজন এবং মঞ্জুর সরদার জানান, স্বাভাবিক জীবনেও তারা নিরাপদ নন। সাবেক দস্যু পরিচয় থাকায় কেউ চাকরি দেয় না। এলাকায় কোনো অপরাধ ঘটলে তাদের দিকেই আঙুল তোলা হয়। প্রশাসনিক হয়রানি, মামলা, সামাজিক অপবাদ—সবমিলে হতাশ হয়ে তারা আবারও বনের পথে ফিরে গেছেন। তবে তারা জানান, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা ও সামাজিক সম্মান নিশ্চিত করা হলে তারা আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন।
সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, দস্যুতার কারণে শুধু মানুষ নয়, বনের জীববৈচিত্র্যও মারাত্মক হুমকির মুখে। বাঘ, হরিণ শিকার করে মাংস, কঙ্কাল ও চামড়া পাচার করা হচ্ছে। বনের কাঠও কাটা হচ্ছে।
সুন্দরবন রক্ষায় আমরা সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ বলেন, “দস্যুদের গডফাদার ও সোর্স দমন ছাড়া বনের শান্তি ফিরবে না।
মোংলা কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের স্টাফ অফিসার লে. কমান্ডার আবরার হাসান জানান, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে নিয়মিত অভিযান চলছে। গত এক বছরে ২৭টি অভিযানে ৪৪ দস্যু ও সহযোগীকে আটক করা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৪৩টি দেশীয় অস্ত্র, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম, ১৭০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ, ৩৬৯টি ফাঁকা কার্তুজ, দুটি ককটেল ও ৪৭৯টি গ্রেনেডের স্প্লিন্টার। জিম্মি ৪৮ জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
বাগেরহাটের সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. রেজাউল করীম চৌধুরী বলেন, বনজীবীদের নিরাপত্তায় টহল জোরদার করা হয়েছে। দস্যুদের অবস্থান শনাক্তে কাজ চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে।


No comments