শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ২৯
শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ২৯
সেদিন সাফায়েতের মেস বাড়িতে কেউ না থাকার সুযোগে বেড়াতে এসেছিল নবনীতা। কোনো ছেলের সাথে এই প্রথম তার কারো বাসায় যাওয়া। নবনীতার এই বাসায় আসার ব্যাপারে কে কাকে জোর করেছে, কে কাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরটা বেশ কঠিন। তবে যেটা হয়েছে দুজনের সমান সম্মতিতেই হয়েছে। সরু একটা গলিতে ঢুকে ড্রেনের সাথেই ছোট একটা লোহার গেট। গেটের সামনের ড্রেনের অংশে কংক্রিটের একটা ঢালাই দেওয়া। নিচু পকেট গেটটা এতটাই নিচু যে বেটে মানুষেরও মাথা নিচু করে ঢুকতে হয়। বেশ পুরনো বাড়ি। কয়েক দফা রাস্তা সংস্কারের জন্য বাড়ির গেট থেকে রাস্তাটা দুই সিঁড়ি উঁচু হয়ে গেছে। গেটের পাশে দেয়ালের সাথে সাদা রঙের নয়নতারার সাথে হলুদ রঙের অন্য কি একটা ফুল যেন প্রেম প্রেম করছে। হলুদ এই ফুলটা নবনীতা চেনে না। স্যাতস্যাতে প্রাচীরের পাশ দিয়ে এগিয়ে দোতলা তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি। নিচতলার গেটটা আরেকটু ভেতরে। সিঁড়ির লম্বা জানালা দিয়ে যে সামান্য আলো আসে সিঁড়িতে তাতে সিঁড়ি স্পস্ট দেখা যায়, তবে আলোটা পর্যাপ্ত না। তবে আকাশটা রোদের দখলে থাকলে রোদের আলো কয়েকটা সমান্তরাল রেখা হয়ে ঢুকে পড়ে সিঁড়ির জানালা দিয়ে। তখন কেউ সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করলে আলোর রশ্মী মানুষটাকে একবার ছুঁয়ে দেয়। গুলুবাবু অবশ্য আলোকে পাশ কাটিয়েই ওঠা নামা করতে পারে। গুলুবাবু নামটা সাফায়েতের দেওয়া। বাস্তবে এটা একটা বড়সড় গাট্টুসগুট্টুস বিড়াল। কোন খাবারে অভক্তি নেই তার। যা পায় সমানে সব সাবাড় করে। তাইতো স্বাস্থ্যের এই অবস্থা। সাফায়েত প্রায়ই তার খাবারের কাটা, হাড়, ফেলে দেয়া অংশ গুলু বাবুর জন্য রেখে দেয়। সাফায়েত একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, গুলুবাবুর জন্য একটা থালা কিনবে। খুব দামি থালা অবশ্য না। এই টিন কিংবা স্টিলের। তবে প্লাস্টিক হলেও চলবে। গুলুবাবুকে খেতে যখন দেয় ই তাহলে খাবারটা প্লেটে দেবে। পশুপাখির যেমন জীবন আছে তেমনি মান-সম্মানও হয়তো আছে। মানুষ তাদের ভাষা বোঝে না সেটা মানুষের ব্যর্থতা। সবাই তো সেই আল্লাহর সৃষ্টি। সবারই তো সম্মান পাওয়া উচিত। গুলুবাবু নিজেকে অসম্মানিত মনে করে সাফায়াতকে যেন কখনো তার নিজের ভাষায় গালি না দেয় সেজন্য ই সাফায়াতের এই প্লেট কেনার ইচ্ছা। বাসা মালিক এখানে থাকে না। শহরের বড়লোক এলাকাতে তার আরো একটা বাড়ি আছে। মাসে ২ বার আসে বাসা ভাড়া নিতে। একবার আসে নির্দিষ্ট দিনে। আর সেদিন যারা দিতে পারে না তাদের টাকা নিতে আসে আরেকদিন। এই বাড়ি রং করা, এমনকি পরিষ্কার করাতেও বাসা মালিক টাকা আর সময় নষ্ট করতে আগ্রহী না। নতুন করে খরচ করা বাদেই মাস গেলে টাকা আসে। সেখানে বাড়তি খরচ করা বোকামী। নিজেরা থাকলেও একটা ভাবনার ব্যাপার ছিল। বাড়িওয়ালার বাবা এই শহরের আদি ব্যবসায়ী। শোনা কথা তিনি নাকি প্লাস্টিক ব্যবসায়ী ছিলেন। ষাটের দশকে এই রেডিমেট বাড়িটা কিনে নেন নামমাত্র দামে। এখানে অনেকবছর ছিলেনও। এই শহর উন্নত হলে বড়লোক এলাকাতে আরেকটা বাড়ি কিনে সেখানে চলে যায়। তার একমাত্র ছেলে এখন বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করায় লোক দিয়ে। তার দিন কাটে ঘুমিয়ে আর রাত কাটে ক্লাবে। বাইরে থেকে গোছানো পরিপাটি সাফায়েত, যে কিনা খুব গুছিয়ে লিখতে পারে, ঠিক তার উল্টোটা ঘরের চিত্র। অগোছালো ঘরের এই সাফায়েত যেন বড্ড ছেলেমানুষ, বোকা, আবেগপ্রবণ। নবনীতাকে বাসায় এনে কি খেতে দিবে সে চিন্তায় একাকার হয়েছিল সাফায়েত। সকালে বৃষ্টি হয়ে শহরের গরমটা কমেছে। কেমন একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব আছে। এই সময় গরুর পায়ের গরম নেহেরীর সাথে কড়া দুটো রান রুটি অমৃত লাগতো। তবে সেসব না পেয়ে শেষমেষ বাসায় ফেরার পথে এক দোকান থেকে প্যাঁকেটে মোড়ানো পাউরুটি, চাটনীর প্যাকেট এনেছিল। আর কফি ওর রুমেই ছিল। বেশ অনেকদিন ধরেই নবনীতাকে কফি বানিয়ে খাওয়ার একটা ইচ্ছা জন্মেছিল সাফায়েতের মধ্যে, যেটা এখন কেবল পূরণ হবার অপেক্ষায়। শহরের বাড়িগুলোতে ব্যস্ত মানুষের বসবাস। কার দরজায় কে কড়া নাড়লো, কার দরজা দিয়ে কে ঢুকলো এসব ভাবার-দেখার সময় নেই। পাঁচতলা সেই মেস বাসায় পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে নিঃশব্দে দরজা খুলে নবনীতাকে জুতা সহ ভিতরে ঢুকতে ইশারা করলো সাফায়েত। ভিতরে ঢুকেই ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো সাফায়েত। বাসার ভেতরে আলো বাতাসের অভাব স্পষ্ট। নবনীতাকে ঠিক এতটা কাছে পেয়ে বিমূর্ত সাফায়েত নবনীতার হাত ছুঁয়ে তাকে নিয়ে গেল নিজের রুমে।
ভীতু নবনীতার কপাল ততক্ষনে ঘামে ভিজে
গেছে। গলা শুকানোর উপক্রম। নবনীতাকে ওয়াশ রুম দেখিয়ে দিয়ে গামছা নিয়ে অপেক্ষায়
আছে সাফায়েত। বেশ ক'দিন যাবত না ধোঁয়া গামছাতে সুবাস লাগার অপেক্ষা মাত্র। রুমে ফিরে
মাথার কাপড় নামিয়ে সাফায়াতের থেকে গামছা নিয়ে হাতমুখ মুছে নিলো নবনীতা। গামছাতে
তার প্রেমিকের ঘামের চিনচেনা গন্ধ। গামছাটা হাতে নিয়েই ঘুরে ঘুরে প্রেমিক সাফায়েতের
থাকার জায়গাটা দেখছে নবনীতা। ফ্লোরিং করা একটা বিছানা, একটা চেয়ার, একটা টেবিল, কাপড়চোপড়
রাখার জন্য প্লাস্টিকের একটা র্যাক, জং পড়া জানালা ঢাকার জন্য অনেক দিনের না ধোয়া
একটা পর্দা, রুমের একটা দেয়ালে বাঁধা দড়িতে বেশকিছু কাপড় ঝুলানো। আজকে নবনীতার আসার
পূর্বাভাস পেলেও সাফায়েত হয়তো গত রাতে ঘরটাকে একটি মানুষ বানিয়ে রাখতো। তবে এ তো
মেঘ না চাইতে বৃষ্টি, তাই ছাতা নেওয়ার সময় পায়নি সাফায়েত। টেবিলের বই-খাতা ছড়ানো-ছিটানো।
একপাশে বইয়ের বিশাল স্তুপ। নিজের মতো করে একটু গুছিয়ে দিচ্ছে নবনীতা। আর চোখ রাঙিয়ে
শাসন করছে প্রেমিক সাফায়েতকে। ব্যাপারটা অনেকটা অধিকার ফলানোর মত। সাফায়েতের কোনো
নিষেধাজ্ঞা নেই। আর সাফায়েতের উপর অগাধ কর্তৃত্ব দেখাতেও নবনীতার কোন আপত্তি নেই।
নবনীতার এমন ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎ ই কোনো কিছু না ভেবেই ওকে শক্ত করে নিজের বুকের সাথে
জড়িয়ে ধরলো সাফায়েত। ঠিক এতটা শক্ত করে এর আগে কাউকে ধরেনি সাফায়েত। এতটা কাছ থেকে
কখনো দেখা হয়নি কাউকে। প্রেমিক হওয়ার সুবাদে সাফায়েত আজ নবনীতার ঠিক এতটা কাছে।
দুজনের মাঝে কেবল দুটো কাপড়ের প্রলেপের দূরত্ব। ভীতু নবনীতা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। তারপর
দ্বিগুণ ভীতু হয়ে নিজেও জড়িয়ে ধরলো সাফায়েতকে। নবনীতার কপালে পর পর কয়েকটা চুমু
দিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিয়ে ততক্ষনে মাতাল হয়ে আছে সাফায়েত। তারপর মাতাল সাফায়েত নেশার
খোঁজে ক্রমে ক্রমে চুমু দিলো নবনীতার কপালে,
দুই গালে, নাকে, কানে আর ঠোঁটে। ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা দীর্ঘস্থায়ী
হলো। এতদিন আলতো চুমুতে খুশি থাকা দুজন আজ যেন বাঁধাহীন। সাফায়েতের ঠোঁট ধীরে ধীরে
নামতে থাকলো নিচের দিকে। কান পেতে শুনে নিলো নবনীতার হৃৎপিন্ডের ধড়ফড়ানি। তারপর কান
পাতা অংশে পরপর কয়েকটা চুমু দিল। মুহূর্তেই যেন বিদুৎ পৌঁছে গেলো নবনীতার মস্তিষ্কে।
তারপর সেই বিদ্যুৎ সাপ্লাই হয়ে গেলো ওর প্রতিটা লোমকূপে। কয়েক সেকেন্ডেই ঘুম ভেঙে গেলো
সব লোমের। নবনীতার চিকন গোলাপী ঠোঁটদুটো তখন কাঁপতে শুরু করেছে। ঠোঁট ভেদ করে অস্পষ্ট
প্রেম নিবেদনের গোংরাণী শোনার অভিজ্ঞতা সাফায়েতের জন্য এটাই প্রথম। পাশ্চাত্যের সিনেমায়
অনেক দেখেছে। আর তার প্রভাবেই এখন নিজেকে নায়ক ভাবতে শুরু করেছে সাফায়েত। অদক্ষ, অনিয়ন্ত্রিত
প্রেমে দুজন যেন দুজনকে ছাড়িয়ে যেতে চায়। ওদের মস্তিষ্কে ভালো খারাপ বিবেচনার চেয়ে
অপরিচিত, অনিয়মিত এই ভালোবাসা, আলিঙ্গনের সর্বচ্চোটা উপভোগের ইচ্ছেটা বেশি প্রাধান্য
পাচ্ছে এখন। চোখ বন্ধ করে নবনীতার মুখ দিয়ে নেওয়া নিঃশ্বাসের শব্দ আর বাহ্যিক সৌন্দর্য্যটা
মনে রেখে হাজারটা কবিতা লেখা সম্ভব সাফায়েতের জন্য, সেটা সে হাজার বছর বাঁচলেও। কারণ
প্রেমিকা নবনীতার অদ্ভুত এক সৌন্দর্য্যের সাক্ষী হয়েছে সে। প্রেমিকা নবনীতা যতটা বাহ্যিক
সৌন্দর্যের অধিকারী, অন্দরেও ততটা আবেদনময়ী, প্রেমময়ী। অনিয়ন্ত্রিত হাতে নবনীতাকে ছুঁয়ে
দেখছে সাফায়েত। তাতে কোনো বাঁধা নেই নবনীতার। এ যে নবনীতার নীরব সম্মতি।
No comments