শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ৩৪
শাহরিয়ার সোহাগ এর "প্রাক্তন"। পর্ব - ৩৪
আচ্ছা আমি চুলায় পানি তুলে দিয়ে আসি। - বললো সাফায়েত।
তুমি আমাকে নিয়ে সেদিন একটা কবিতা লিখেছিলে। 'একদিন তোমায় ডুবিয়ে মারবো দেখো, তুমি সাঁতরাবে আমার গল্পে। কিংবা
ডুব দেবে আমার কবিতার ছন্দে।' এটুকুই মনে আছে। - সেই দিনের কথা মনে করার চেষ্টা
করলো নবনীতা।
বাহ, তোমার স্মৃতিশক্তি আসলেই চমৎকার। - আবারো যেন
অবাক হলো সাফায়েত।
লাখো লাখো তরুণীর হৃদয়ের স্পন্দন, তাদের কাঙ্ক্ষিত
পুরুষ, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা কবি সাফায়েত নিজ হাতে আমাকে কিছু বানিয়ে খাওয়াবে,
সেটা গরম পানিতে একটু চিনি দিলেও অমৃত লাগবে আমার কাছে। - অপ্রকাশ্য কষ্ট নিয়েও হাসার
চেষ্টা করলো নবনীতা।
কি অদ্ভুত, তাইনা? আজ তুমি আমাকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে
থাকা কবি বলে সম্মোধন করেছো। অথচ তোমার আমার সম্পর্কে দূরত্ব আসার পেছনে এই লেখালেখি
একটা কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। - সাফায়েতের অভিমান
ভরা প্রতুত্তর।
আজকে আমার জন্মদিন। সদ্য জন্ম নেয়া শিশু আমি। এই ভারি
কঠিন কথাগুলো আজকে না বললেই কি নয়? আজ না হয় আমাদের সুন্দর সময়গুলোর কথা বলি। -
অনুরোধ করলো নবনীতা।
দুই মগ কফি নিয়ে হাজির হলো সাফায়েত। ততক্ষনে বুকসেলফ
সাজানো সাফায়েতের নতুন বইগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে
দেখছে নবনীতা। - শোনো তোমাকে চিনি কম দিয়েছি। যতটুকু মনে পড়ে তুমি তো চিনি কম খাও জানি।
পুরো বাসাতেই একা কেন থাকো। কাউকে সাথে রাখলেই তো পারো।
- হাতে একটা বই নিয়েই চেয়ারে এসে বসলো নবনীতা।
লেখক হিসেবে আমি যতটা সামাজিক, ব্যক্তি হিসেবে আমি
ততটাই অসামাজিক হয়ে গেছি। আমি যখন লেখালেখির ঘোরে থাকি, তখন আমি কাউকে সহ্য করতে পারিনা।
কারো সাথে কথা বলি না। যদি কাউকে রাখি তাহলে তার সময়টায় বরোং খারাপ হবে। কি দরকার
একজনকে ডেকে এনে তাকে খারাপ সময় উপহার দেওয়ার। - নবনীতাকে কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে হাসতে
হাসতে উত্তর দিলো সাফায়েত।
এখন প্রেম করো? বিয়ে কবে করবে? - সাফায়েতের কাছে জানতে
চাইলো নবনীতা।
বিয়ের কথা বলতে পারবো না। তবে প্রেম করতে চেয়েছিলাম
একবার। সেটাও তোমার প্রতি আমার তীব্র ভালোবাসার বিষন্নতা থেকে। তারপর রিকশায় ঘোরাঘুরি
করেছি রেস্টুরেন্টে খেয়েছি, এই পর্যন্তই। কেন জানি ওদের গন্ধটা আমার ঠিক মনে ধরেনি।
আজও আমি তোমার গন্ধটা মিস করি। মানুষের মিছিলে আমি ঠিকই তোমার গন্ধটা চিনতে পারবো।
এই যে কফির মগটা, এটা তোমার দেওয়া ছিল। চিনতে পেরেছো? - কফির মগে চুমুক দিতে দিতে উত্তর
দিচ্ছিলো সাফায়েত।
কি থেকে কি হলো জানিনা। কেন ই বা আমার সহজ জীবনটা এত
জটিল হলো আমি নিজেও জানিনা। তবে তোমার চোখে যে প্রেম, হাসিতে যে মুগ্ধতা, কিংবা তোমার
শরীরে প্রেমের যে গন্ধ, তা আমাকে মাঝে মাঝে খুব কাঁদায়। তোমাকে হারাতে না চেয়েও আজ
তোমার থেকে আমার দূরত্ব কয়েক মহাকালের। জেদের বশে বিয়ে করেছি ঠিকই, তবে তার আর আমার
শরীরের মাঝেও আমি তোমার গন্ধের একটা অদৃশ্য প্রাচীর অনুভব করতাম। - কফির মগটা রেখে
ডানহাতের তর্জনী আঙুল দিয়ে চোখদুটো আলতো করে মুছে নিলো নবনীতা, যেন চোখের নদীর বাঁধ
ভেঙে গালে গড়িয়ে না পড়ে।
বাহ, আমি তো ভাবতাম আমিই তোমাকে মিস করি। এখন জানলাম,
না, আমার প্রাক্তন প্রেমিকাও আমাকে মিস করে। - জোরেই হেসে উঠলো সাফায়েত।
তোমার বাসাতে এলাম। কোনো সমস্যা হবে না? - প্রশ্ন করলো
নবনীতা।
সাফায়েত এখন সেই ভার্সিটি পড়ুয়া সাফায়েত নেই। সাফায়েত এখন নিজের যোগ্যতাতেই
আলোচিত নাম। তার বাসাতে গেস্ট আসতেই পারে। - উত্তর দিলো সাফায়েত।
বিয়ে করবে কবে? - প্রশ্ন করলো নবনীতা।
: আমার যে নগ্নতা ছুঁয়ে দেখেছো তুমি, আমি চাইনা সেই দেহে চোখ পড়ুক অন্য কারো।
তাই তোমার বিয়োগে আমি আজও সঙ্গীহীন, পথ চেয়ে আজও সেই তোমারই।
: আমার জন্য পথ চেয়ে থেকে কি হবে? আমি তো আর তোমার মত সৎ থাকতে পারিনি। কী
করলাম জীবনে? তোমার মত একজনকে পেয়েও হারালাম! ভুল বুঝলাম, জেদ করলাম, অভিমান করে বিয়ে
করে শুয়ে পড়লাম অন্য পুরুষের সাথে।
: তোমার কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে তুমি সেটাই করেছো। যা করেছো সেটা স্বীকৃত
ভাবেই করেছো। এটাতে আমি দোষের কিছু দেখি না।
: যাকে ভালোবাসা হয় তার কোন দোষ চোখে পড়ে না।
: দোষগুণ বুঝি না। ভালোবাসাটা ই বুঝি আমি।
: আমার আফসোস আমি তোমাকে তোমার মত করে ভালবাসতে পারিনি, ঠিক যেভাবে তুমি আমাকে
ভালোবেসেছো।
: সবার সব চাওয়া কি পূরণ হয়? এই যেমন কত হাজার বার যে আমি তোমাকে চেয়েছি।
কিন্তু কই, তোমাকে তো আমি পাইনি।
: আমাকে না পেয়ে বোধ হয় ভালোই করেছো। আমি তোমার জীবনের উৎসাহ ছিলাম না। আমার
মনে হয় আমি ছিলাম তোমার জীবনের একটা বিশাল তিক্ততা। তোমার জীবনকে বিষিয়ে তুলছিলাম।
: আমাদের বিচ্ছেদের জন্য আমি প্রকৃতি আর পরিবেশকেই দায়ী করি। না আমার কোনো
দোষ ছিল, না তোমার কোন ভুল। তখন তোমার কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে তুমি সেটাই করেছো।
: তোমার কোন দোষ ছিলনা। যা করার আমি করেছিলাম।
: প্রবাদে আছে, এক হাতে তালি বাজে না।
: তবে তোমার দোষটা কি?
: নিজের দোষ কি নিজে বলা যায়?
: পুরনো কথা টেনে কি হবে? নিজেরা তো নিজেদের জীবনের একটা রুটিন বানিয়েই নিয়েছি।
আজ যেতে হবে আমার।
: উত্তর দেবে না? নাকি আবারো কয়েক জনমের অপেক্ষা করে তোমাকে খুঁজে বের করতে
হবে তোমার উত্তরের জন্য?
নবনীতার চোখ ভেজা। তবে সে খুব করে তা লুকাতে চাচ্ছে সাফায়েতের থেকে। নবনীতা
কফির মগটা রেখে ব্যাগটা কাঁধে নিলো। - তোমার আর নামতে হবে না। আমি চলে যেতে পারবো।
: কেন? এখন আর আগের মত সমস্যা নেই তো।
আমি আমাদের সেই তখনকার দিনের সময়টাকে মিস করছি। আজ সেটার পুণরাবৃত্তি করি?
- উত্তর দিলো নবনীতা। তবে নবনীতার এমনটা করার কারণ হলো সে চায় না সাফায়েত তার সাথে
নিচে নামুক, তার সাথে যাক, তার বাসা চিনে যাক।
দরজা খুলে নবনীতা নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি বেঁয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে সাফায়েত। একটা একটা
সিঁড়ি পেরিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলো নবনীতা। জীবনে অর্জনগুলো আপেক্ষিক। জীবন খুব ছোট।
আমরাই বড়ো করে দেখি। জীবনে সফলতা থাকলেও সার্থকতা ছাড়া জীবন শূণ্য। ভেজা চোখে শূণ্য
হাতে শূণ্য ঘরপানে সাফায়েত। পেছন থেকে সাপায়েতকে জড়িয়ে ধরলো নবনীতা, সাফায়েত কিছু বুঝে
ওঠার আগেই শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে চাপা কান্না কাঁদছে নবনীতা। নবনীতার ফিরে আসা
কি তবে আজীবনের। নাকি আজীবনের জন্য হারিয়ে হারাবে বলে বিদায় নিচ্ছে।
No comments