ভারতীয় আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে এখন সময় নিজেদের শক্তি প্রমাণের || শাহরিয়ার সোহাগ
বিগত কয়েক যুগ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে ভারত নিজেদের প্রভাব বিস্তারে সর্বচ্চো চেষ্টা করে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে চাপ প্রয়োগ এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের নামে একতরফা সুবিধা আদায় - এসবই ভারতের আগ্রাসী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশও এই আগ্রাসনের শিকার। তবে এখন সময় এসেছে আমাদের নিজেদের দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে বহিঃআগ্রাসন মোকাবেলা করা।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী দ্বারা নিয়মিতভাবে গুলি চালানো এবং হত্যার ঘটনা ঘটছে। এবং বিগত দেড় বছরে এই সংখ্যা পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। তবে বিগত সরকার তার ভারতপ্রীতি মনোভাবের জন্য সীমান্ত সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়নি। আগ্নেয়াস্ত্র, ফেনসিডিল সহ অন্যান্য মাদক ছড়িয়ে দেবার মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি প্রজন্ম ধ্বংসের যে নীল নকশা আঁকা হচ্ছে, সেটাও ভারতের আগ্রাসনের একটা লক্ষণ মাত্র।
বাংলাদেশের জনগণ বছরের পর বছর ধরে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য পাওনার জন্য অপেক্ষা করলেও ভারত সরকার এই ইস্যুতে বারবার আশ্বাস দিয়েও কার্যকর কোনো সমাধান করেনি। বরং তারা নিজেরা একতরফাভাবে পানি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জনজীবন ও চাষাবাদে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।
অন্যদিকে, ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে। দেশের স্থানীয় শিল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ সস্তায় ভারতীয় পণ্য ঢুকিয়ে তারা আমাদের শিল্পের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা ধ্বংস করছে। এছাড়া ভারত ট্রানজিটের নামে আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে নিজেদের অর্থনৈতিক সুবিধা নিশ্চিত করলেও, আমরা বিনিময়ে বাংলাদেশ তেমন কোনো সুফল পাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে বিভিন্ন গুজব এবং ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্ক এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এই ধরনের অপতথ্য প্রচারের উদ্দেশ্য শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যমে এবং রাজনীতির অঙ্গনে ভারতীয় কিছু চ্যানেল এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রচারিত ভুল তথ্য নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা চলছে। একদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে জটিল করে তোলার অপপ্রয়াস অন্যদিকে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে ভিত্তিহীন প্রতিবেদনের মাধ্যমে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম বাংলাদেশ নিয়ে ভুয়া খবর ও গুজব ছড়িয়েছে। এমন ভুয়া খবর প্রচারের তালিকায় ভারতের অন্তত ৪৯টি গণমাধ্যমের নাম উঠে এসেছে বাংলাদেশের তথ্য যাচাই সংস্থা রিউমর স্ক্যানারের এক প্রতিবেদনে।
ভারতের গণমাধ্যম রিপাবলিক বাংলা সর্বাধিক ৫টি গুজব প্রচার করেছে বলে জানিয়েছে রিউমর স্ক্যানার। এরপর রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও লাইভ মিন্ট; যারা প্রত্যেকে অন্তত তিনটি গুজব প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির জন্য এক বড় ধরনের ধাক্কা, সেটা স্পষ্ট। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর ভারত দীর্ঘদিন ধরে যে রাজনৈতিক প্রভাব এবং আধিপত্য গড়ে তুলেছিল, তা বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক নিমিষে ভেঙে পড়েছে। মোদী সরকার হয়তো কল্পনাও করেনি যে, তাদের অনুগত এই দেশটি একদিন এমন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে।
সময় এখন নিজেদের শক্তি ও মর্যাদা প্রমাণ করার। বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের দাবি তুলে ধরতে হবে এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে আরও ভারসাম্যপূর্ণ করতে হবে।
জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জনগণের ঐক্যই সবচেয়ে বড় শক্তি। রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভারতের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। ভারতের আগ্রাসন থেকে মুক্তি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক প্রয়াস নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার প্রশ্ন। এখনই সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার।



No comments