Header Ads

মানুষ -- ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১৫

Shahriar Sohag, শাহরিয়ার সোহাগ, মানুষ, উপন্যাস, Novel, romantic bangla Novel, bangla Novel for love,  bangla Novel, কুকুর নিয়ে গল্প, পশু নিয়ে গল্প

নায়ক নায়িকার এমন কিদ্দানী দেখে চায়ের দোকানের সবাই হো হো করে হাসতে থাকে। জাকির যখন বুঝতে পারে ওর দোকানে কোন খাবার না কিনে লোকজন বসে হুদাই রেস্ট নিচ্ছে আর টিভি দেখছে, জাকির তখন সিস্টেমে টিভি বন্ধ করে দিয়ে বিদ্যুৎ অফিসের লোকজনকে গালিগালাজ করে। তারপরও কেউ বসতে চাইলে কোনো খাবার কেনে, না বসতে চাইলে চলে যায়। এখানে বসে শুধু শুধু টিভি দেখলে হবে না, কিছু খেতে হবে, না হলে চলে যেতে হবে। কিছু মানুষ আছে যারা তো খাবার না কিনে এমনভাবে টিভি দেখতে থাকে যেন আস্তো টিভিটা ই খেয়ে ফেলবে।

 

দুইটা ছেলে মানুষ জাকিরের দোকানে ডাব কিনতে আসলো। জাকির তো দাম কম রাখবেই ই না। তারা ম্যালা কথা খরচ করে দশ টাকা কমাতে পারলো। তাতে অবশ্য লাভ খুব একটা হয়নি। দশ টাকা বাঁচাতে গিয়ে যে পরিমাণ কথা খরচ করেছে তার জন্য ত্রিশ টাকার এক প্যাকেট বিস্কুটও কিনতে হলো। এই দ্বীপে ঘুরতে আসা অনেকেই এই দুটো ছেলের মত বুদ্ধিমান। তারা ২০ টাকা ভাড়া বাঁচানোর জন্য পায়ে হেটে যায়। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় যা পায় তাই কেনে। দুইশ টাকার জিনিস কিনে ঘরে ফিরে হিসেব করে দেখে এই দুইশ টাকার মধ্যে একশ আশি টাকার জিনিসই কোন কাজের না। এসব বাঙ্গালীদের জন্য একটা প্রবাদ আবিষ্কার হয়েছিল। অতি চালাকের গলায় দড়ি। দুইটা ছেলে ডাবের পানি পাইপ দিয়ে চুপচুপ করে টেনে শেষ করলো। ওরা পাঁচ বন্ধু দূর থেকে দুই ছেলেকে দেখছে। ওদের ক্ষুধা লেগেছে, আর এভাবে ডাব খেতে দেখে যেন ক্ষুধা আরো বেড়ে গেছে। ওরা অপেক্ষা করছে ডাবের মালাটা কখন জাকির নিয়ে ফালায় দিবে। তবে ছেলেমানুষ দুইটার ফেলানোর কোন নাম গন্ধ নেই। একটা ডাব খেতে যদি এতক্ষণ সময় লাগায় তাহলে তো ওদের জীবনে উন্নতি হবে না। ডাবের পানি খাওয়া শেষ করে ভিতরের আঁশ খাওয়ার জন্য জাকিরকে দিলো ডাব কেটে দিতে। জাকির ডাব দুটো কেটে দিল, ডাবের পাশে দায়ের কোপে চামচও বানায়ে দিলো। তবে ভেতরে বেশি আঁশ হয়নি এই বলে ডাব দুটো ফেলে দিতে চাইলো জাকির। তবে ছেলে মানুষ দুইটা বললো ভিতরে যা অল্প একটু আছে ওরা সেটাই খাবে। 

জাকির ওদেরকে বোঝালো - এই যে কিছু অবলা জীব আছে, এরা তো আমার আপনার দয়াতেই বেঁচে আছে। আপনার আমার পকেটে টাকা আছে, চাইলেই কিছু কিনে খেতে পারি। ওদের তো জামা কাপড়ও নেই, জামাকাপড়ের পকেটও নেই, পকেটে টাকা নেই। তবে ওদের জন্য তো আমরা আছি। প্রতিটা জীবনই তো অনেক দামি তার পরিবারের কাছে। আমাদের সবার অল্প একটু দয়া ওদের জন্য অনেক বড় কিছু। সব যদি আপনারা খান তাহলে আমার বডিগার্ডগুলা কি খাবে?

: আপনার দয়া আপনি আপনার কাছেই রাখেন। পুরান পাগলে ভাত পায় না নতুন পাগলের আমদানি, তাইনা? ওদের জন্য আপনার দরদ উতলায় উঠতেছে তাহলে আপনি ওদেরকে খাওয়ান। আমরা টাকা দিয়ে জিনিস কিনছি সেটা আমি আপনার কথা মতো ওদেরকে কেন দেবো? 

জাকির এবার ওদের ধমক দিয়ে বসলো। - আরে ব্যাটা  ডাব কিনে খাচ্ছো বলে কি সব খাবা নাকি?

: আমরা ডাবের টাকা দিছি আমরাই ডাব খাব।

: কি তুই আমারে টাকার গরম দেখাইলি? ঠিক আছে, তোরা ডাব কিনছিস তোরা ডাব খাবি। না খাইলে কি করবি সেটা তোদের ইচ্ছা। কিন্তু যেহেতু তোরা পুরো ডাব কিনেছিস, এই ডাবের ছোবলা তোরা রেখে যেতে পারবি না। এটা তোদের নিয়ে যেতে হবে।

: আমরা নিয়ে যাব মানে?

: দরদাম করার সময় ডাবের দরদাম করেছিস। শুধু ডাবের পানির জন্য তো দরদাম করিস নি, ছোবলা সহই তো করেছিস। এখন ছোবলা শুধু নিয়ে যাবি না এই দ্বীপের কোথাও তোরা এটা ফালাইতে পারবি না। তোরা না টাকা দিয়ে কিনছিস, তাহলে ফালাবি কেন? দরকার হলে আমি দোকান বন্ধ করে তোদের পিছে পিছে ঘুরবো। তুই এই দ্বীপে ফালাইতে পারবি না।

: দ্বীপ কি আপনার বাপের নাকি?

: দ্বীপ পুরোটা আমার বাপের একার না হইলেও এই দ্বীপ আমার দাদার, তার দাদার, তার দাদার, মানে আমার পূর্বপুরুষের। কিন্তু এই দ্বীপ তোদের না, তোদের বাপেরও না, তোদের দাদারও না, তোদের পূর্বপুরুষদেরও না। তোদেরকে দয়া করছি তাই তোরা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। কিন্তু তোদের ডাবের ছোবলা তো এই দ্বীপ হজম করবে না। এখন তোরা বল এই ছোবলাগুলা কি আমি ফালায় দেবো নাকি তোরা খেয়ে আবার জাহাজে করে বাড়ি নিয়ে যাবি?

জাকিরের কথা শুনে দুইটা ছেলে ভড়কে গেলেও দোকানের অন্যরা বেশ মজা পাইছে। ওরা ডাবের বিল দিয়ে চলে যেতেই পাঁচ বন্ধু এসে জাকিরের পায়ের কাছে লাইন দিয়ে বসলো।

: দেখ নবাবজাদারা, তোদের জন্য আমার স্বজাতির সাথেও আমি গ্যাঞ্জাম করি। তোদের জন্য খাওন রেডি করি। আর তোরা মাঝে মাঝে আমার দেয়া খাবার না খেয়ে চলে যাস। কুকুরের পেটে তো ঘি ভাত সয়না। সেই ঝড়ের রাতে তোরা আমার দোকান বাঁচায়ছিলি, এই জন্য এই দোকানের ইনকাম দিয়ে তোদের ভালোবাসি। আমার দোকানের উপর খেয়াল রাখিস। যা, এগুলা খেয়ে চোখের সামনে থেকে যা। - এই বলে ডাবের মালা দূরে ছুড়ে মারলো জাকির।

 

ডাবের মালা ছুঁড়ে ফেলার আগ পর্যন্ত ওরা একদম নিরীহ প্রাণীর মতো জাকিরের পায়ের কাছে পড়েছিল। যখন ই জাকির ডাবের ছোবলা দূরে ছুঁড়ে মারলো, তারপরে যেন ওরা সেই দিকেই ভোঁদড়।

জাকির মানুষটা খুব ভালো রে। আমাদের জন্য আজকে কি না করলো। - খেতে খেতে বললো ইকি।

তা ঠিক বলেছিস। ও যে আমাদের কত ভালোবাসে তার প্রমাণ দিলো। - ইকির সাথে যোগ করলো গুলু।

জাকিরের মত মানুষগুলোর জন্যই তো এখনো মানুষদেরকে ভালো বলতে ইচ্ছে করে। - বললো ইশি

 

সবাই গল্পে গল্পে ভাগাভাগি করে ডাবের মালা শেষ করে আরামের ঢেঁকুর তুললো। এই মিলটা বেশ দারুণ। কারো মধ্যে একা খাওয়ার মানসিকতা নেই। যেই খাবার যতটুকুই পাক সবাই মিলেই খায়। মানুষের থেকে ওরা এইদিক থেকে বেশ এগিয়ে। মানুষ তো পারলে আরেক জনের মুখের খাবারও ছিনিয়া নেয়। আপন মানুষের হক মেরে খাওয়ার জন্য তো মানুষ ওস্তাদ। সেখানে দূরের মানুষের কথা আর কিবা বলা যাবে। এই অভাবের দ্বীপে ওদের বন্ধুদের খাবারের অভাব আছে ঠিকই, কিন্তু ওদের বন্ধুত্বের ভালবাসার কোন অভাব নেই। মানুষও মানুষকে ভালবাসে খাবার দেয়, সেটা দেখিয়ে, ক্যামেরার সামনে। মানুষ তো পারলে একশো টাকা দান করে এক হাজার টাকা খরচ করে সেটা প্রচার করে। সে যে দানশীল এটা নিজ দায়িত্বেই মানুষকে জানায়। নির্বাচনের প্রচারে সব দলের নেতা, পাতিনেতারা বলে জনগণ তাদের পাশে আছে। নিজেদের পোস্টারের নিচে লিখে প্রচারের এলাকাবাসী। অথচ এই এলাকাবাসী, এই জনগণ কেউই এসবের কিছুই জানে না। নেতারা প্রথমে  জনগনের থেকে চাঁদা নেয়, জনগনের টাকা মেরে সেই টাকা নিজের করে নেয়। তারপর সেই টাকা খরচ করে জনগণের নাম দিয়ে বুঝাইতে চায় জনগণ তাদেরকে অনেক ভালোবাসে। দল ক্ষমতায় না থাকলে এই জনগণ যে তাদেরকে সালামও দিবেনা সেটা ওরাও জানে।

 

 

ওরা পাঁচ বন্ধু তখন জেটি ঘাটে বসে জাহাজের অপেক্ষা করছে। হাজার হাজার মানুষও ওদের সাথে অপেক্ষায়। ওদের অপেক্ষার কারণ আর ধরন ভিন্ন। জাহাজ এলো বড় বড় ক্যামেরা নিয়ে একদল মানুষ আসলো। ওরা পাঁচ বন্ধু বুঝে উঠতে পারছে না ওরা কারা। তবে ওদের খুব জানতেও ইচ্ছে করছে।  কিন্তু এখনো খাবার জোগাড় করতে পারেনি ওরা। এতগুলো মানুষ একসাথে এসেছে যখন খুঁজে বের করা যাবে। তার আগে খাবার তো জোগাড় করতে হবে। এতগুলো মানুষ আর বড় বড় ক্যামেরা দেখে ওদের সবারই কৌতূহল বেরিয়ে গেছে। তবে কেউ কাউকে বলতে পারছে না। খাবার জোয়ার করে খেয়ে জাকিরের দোকানে গিয়ে জানতে পারলো দুপুরে ওরা যাদেরকে আসতে দেখেছে ওরা এখানে সিনেমার শুটিং করতে এসেছে। এখনকার সময়ের সবচে জনপ্রিয় নায়িকা নাজমা এসেছে। নাজমার নাম শুনে ওদের কৌতূহল আরো বেড়ে গেছে। এতদিন ওরা নাজমাকে টিভিতে দেখেছে। এখন সরাসরি দেখার সুযোগ। সেটা কি আর হাতছাড়া করা যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। ওরা চলে গেলো নায়িকার শুটিং এর জায়গায়। খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি খুব একটা। এত বড় নায়িকার খবর দ্বীপের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। ওদের পাঁচ বন্ধু ছাড়াও আরো অনেকে এসেছে, বহু মানুষ ভিড় করেছে। নায়িকার সাথে অনেকে সেলফি তুলছে। ওদেরও শখ হয়েছে ইস যদি একটা সেলফি তুলতে পারতো। সেটা তো হবে না। ওরা পাঁচ বন্ধু চায় নায়িকা অন্তত ওদের গায়ে একটু হাত বুলিয়ে আদর করে দিক। তাহলে অন্তত সামনের এক সপ্তাহ ভাব নিয়ে চলতে পারবে। এর আগে একটা শুটিং টিমের থেকে পচা বিরিয়ানী খেয়ে পূর্ব পাড়ার মখার ভাবের ঠ্যালায় টিকে থাকা যাচ্ছিল না। আর এখন যদি নায়িকা ওদের কারো গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় তাহলে তো কথাই নেই। সুযোগ বুঝে একটু একটু করে ওরা পাঁচ বন্ধু এগোতে থাকলো নায়িকার দিকে। একসাথে ওদের পাঁচজনকে দেখে নায়িকা ভয়ে চিৎকার করে উঠলো। শুটিং টিমের অন্যরা এসে নায়িকাকে বাঁচালো, ওদের পাঁচ বন্ধুকে দৌঁড়ানী দিলো। দৌঁড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জাকিরের দোকানের কাছে এসে যেন জীবন বাঁচালো।

এটা কোন কথা? দুনিয়ায় এত পশু পাখি থাকতে সালার নায়িকা আমাদেরকেই কেন ভয় পাবে? - মেজাজ হারালো ইকি।

ওরে কি আমরা কামড়াইছি নাকি চুমাইছি? সর্বচ্চো ওর কাছে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়া থাকতাম যেন আমাদের একটু আদর করে দেয়। এটা কি খুব বেশি চাইছিলাম? - যোগ করলো ইশি।

নায়িকার ন্যাকামির খেলায় এভাবে দৌঁড়াইতে হলো। - বললো তাহি।

এই নায়িকার সিনেমা আর দেখবোই না। এই নায়িকার পেছনে না ঘুরে খাবারের ধান্দা করলেও কাজে লাগতো। চল সবাই ধান্দায় বের হই। - সবাইকে বললো গুলু।

 

 

 

এক সন্ধ্যায় সমুদ্রপাড়ে সব বন্ধু বসে আড্ডা দিছে, বালি নিয়ে, পানি নিয়ে খেলা করছে।। এই দ্বীপে কে কয়টা প্রেম করেছে, কোন মানুষ নিজের ঘরের মানুষ রেখে অন্য ঘরের মানুষ নিয়ে রোমান্স করতেছে সেসব নিয়েই বন্ধুরা মিলে হাসি ঠাট্টা করতেছে।  ইকির কোনো গল্প নেই। ইকির গল্পের পুরোটা জুড়েই তাহি। তাহিকে তো ইকি ওর রাজ্যের রাণী বানাতে চায়, তবে তাহি ই উত্তর দেয় না। দেবে দেবে করে তো অনেকদিন ই হলো। ইকি হঠাৎ ইমোশনাল হয়ে পড়লো। ধৈর্য্যহারা হয়ে গেলো। তাহির উত্তরটা ওকে জানতেই হবে। ও জানতে চায় আরো কতটা ভালোবাসলে সে তাহির মন পাবে। ভালোবাসলে সবাই নাকি লজ্জা শরমের মাথা খায়। ইকির অবস্থাও তাই। ইকি সব বন্ধুদের মধ্যে হঠাৎ ই তাহিকে জোর করলো ওর উত্তরের জন্য। ইকির একটাই কথা। পছন্দ করে বা করেনা, ভালোবাসে বা বাসে না, প্রেম করবে বা করবে না সেটা তো ক্লিয়রলি বলতে হবে। পেটের ভেতর নাড়ীর সাথে কথা পেঁচিয়ে রাখা নারী জাতির জন্মলগ্ন অভ্যাস। ইকি আজকে নাছোড়বান্দা। আর তাহিকে কিছু একটা বলতেই হবে। তাহি একটা দিন সময় নিলো। কথা দিল আগামিকাল সকালে যখন দেখা হবে, তখন তাহি ওর মনের কথাটা জানাবে। বন্ধু মহলে সবাই ধরে নিয়েছিল তাহির উত্তরটা পজেটিভ হবে। তাহির হাবভাবে সেটাই তো মনে হয় সবার। তবে মেয়েদের মন বোঝা মুশকিল। সে মানুষ হোক বা পশু। সবাই খুব এক্সাইটেড ছিল এটা ভেবে যে তাহি উত্তরটা ঠিক কিভাবে দেবে। আর এতদিন পর সম্মতি মেয়ে ইকি কিভাবে সেটা পালন করবে।

রাতে ইকি ঘুমিয়েছিল পশ্চিম সমুদ্রপাড়ে। ঘুম থেকে সকাল সকাল উঠে সমুদ্রপাড়েই হাটাহাটি করছিল আর ভাবছিল তাহি ওকে কি কি বলতে পারে, তাহির কোন কথার উত্তরে সে কি উত্তর দেবে।  তাহি যে ওকে অপছন্দ করে তা নয়। তবে তাকে যে পছন্দ করে সেটা ই কিছুক্ষণ পর দেখা হলে অফিসিয়ালি জানাবে। জাকিরের দোকানে সিনেমায় দেখেছে নায়িকা রাজি হয়ে একটা হাসি দিলেই নায়ক নায়িকা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে সমুদ্রপাড়ে এসে নাচানাচি করে। ইকির জন্য ভালো খবর হলো এরা দুজনই আগে থেকেই সমুদ্রপাড়েই থাকে। এখন তাহি রাজি হলেই খেলা জমে যাবে। প্রেমিকাকে নিয়ে ওর যে স্বপ্নগুলো ছিল তা সব এক এক করে পূরণ হবে। ইকির এত বছরের অপেক্ষা আজ সত্যি হবে। সে ভীষণ খুশি।

এই ভোর সকালে কিছু মানুষও হাঁটতে এসেছে সমুদ্রপাড়ে। ভোরবেলা সমুদ্র দেখলে নাকি সারাদিন মন ভালো থাকে। ইকি কি ওদের কাছে কিছু চাইবে? না থাক, কল্পনাতে যে সময়টা চলমান, বরং সেটাই চলুক। কল্পনা সুন্দর, তাই সবাই কল্পনা করতে ভালোবাসে। বাস্তবে যা যাওয়া সম্ভব না, কল্পনাতে তা চোখের পোলকে সম্ভব। সমুদ্র পাড়ে একপাশে ইকি একা বসে তাহিকে নিয়ে কল্পনার সাগরে ভাসছিল। তার সেখে একটু পাশেই ওই মানুষগুলো ন্যাকামি করছিল। করুক, যার মজা তার কাছে।

হঠাৎ ই এই মানুষগুলোর কয়েকজন ইকির গায়ে পানি, বালু ছুঁড়ে ইকিকে টিজ করতে তাকে। ইকি ওর কল্পনাতে মানুষের এমন বাঁধা আশা করেনি। পৃথিবী সবার। কেউ কারো ক্ষতির কারণ কেন হবে। তবে এটাই যেন মানুষগুলোর আনন্দ। ইকি দুপা এগিয়ে ওর ভাষাতে উচ্চস্বরে মানুষের এমন কাজের প্রতিবাদ জানায়। আর তাতেই ওই মানুষগুলোর দলের দুইটা মেয়ে মানুষ ভয়ে দৌঁড় দেওয়ার সময় পড়ে ব্যথা পায়। এতেই বাকি পুরুষ মানুষগুলো ক্ষেপে যায় ইকির উপর। ইকির জাতের কেউ তখন ছিলোও না আশেপাশে। এই ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করেই কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা মানুষ সমুদ্রপাড়ে পড়ে থাকা একটা পাথর তুলে সজরে ইকির দিকে ছুড়ে মারে একজন। ইকি অন্য মানুষদের দিকে তাকিয়ে প্রতিবাদ করায় সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই পাথর গিয়ে লাগে ইকির মাথায়। ইকির চারপাশ ঘোলা হতে শুরু করে। মানুষগুলো ইকির রক্তাক্ত চেহারা দেখে মানসিক শান্তিতে হাসতে হাসতে চলে যায়। আর ইকি তার চিরচেনা সমুদ্রের পাড়ে বালুতে শুয়ে কাঁতরাতে থাকে। তার মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে। ঢেউ এসে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ফিরতি ঢেউয়ে তার রক্ত গিয়ে মিশছে বিশাল সমুদ্রে।

ইশি, তাহি, টুকি, গুলু জাকিরের দোকানের সামনের সমুদ্রপাড়ে চলে এসেছে। ইকির তো আসার কথা সবার আগে। তবে ওর আসতে দেরী হওয়াতে ওরা চিন্তা করছে। কাল ইকি টুকি একসাথে ছিল না। তাহির হাবভাবেও মনে হচ্ছে সে হ্যা বলার জন্য প্রস্ততি নিয়ে এসেছে। মানুষের নিয়ন্ত্রিত এই দ্বীপ সব প্রাণীর জন্যই অনিরাপদ। এটা ভেবেই ওরা সব বন্ধু সমুদ্রপাড় দিয়ে হাটতে হাটতে ইকিকে খুঁজছে। ইকিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হাটতে হাটতে পশ্চিম পাড়ে এসে ওরা ওদের বন্ধু  ইকিকে খুঁজে পায় ওদের চিরচেনা সমুদ্রের পাড়ে রক্তাক্ত অবস্থায়, নিথর দেহে। ততক্ষণে ইকির দেহ থেকে প্রাণটা আলাদা হয়ে গেছে। কে বা কারা পাথর মেরে রক্তাক্ত করেছিল ইকিকে। আর তাতেই ওদের প্রিয় বন্ধুটি মারা গেছে। প্রতিটা মানুষের কাছেই তার প্রিয় প্রাণীটি ছাড়া বাকি সবার জীবনই মূল্যহীন। নির্দয় মানুষ মানতেই চায় না যে সে যার উপর জুলুম করছে, সেও কারো না কারো প্রিয়জন, ভালোবাসার মানুষ।  তাহি খুব আশা বেঁধেছিল আজ সে ইকিকে তার ভালোবাসার কথাটা বলবে। কিছু মানুষের পাষবিক আনন্দের জন্য মারা গেছে তার ভালোবাসার ইকি।  ইকিকে ভালোবাসার কথা বলা হলো না তার।


২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বীর শহিদ ও অকুতোভয় আন্দোলনকারীদের স্মরণে ও সম্মানে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস বাংলা বসন্ত। অর্ডার করতে ক্লিক করুন

No comments

Powered by Blogger.