হুমায়ূন আহমেদ, বাংলা সাহিত্যের বাদশাহ নামদার || শাহরিয়ার সোহাগ
একজন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, যাদুশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক। বাংলাদেশের সাহিত্যভুবনে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব তিনি। জনপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী লেখক। তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা, তরুণপাঠক সৃষ্টিতে রেখেছে অনন্য অবদান।
বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশে সর্বাধিক উজ্জ্বলতম নক্ষত্রসমান এই মানুষটির মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১১ বছর আগে, ২০১২ সালের ১৯ জুলাই, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে, মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর।
হুমায়ূন আহমেদ ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর, নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জে তাঁর মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শহীদ ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজ। তাঁর অনুজ মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের একজন শিক্ষাবিদ এবং কথাসাহিত্যিক, আরেক ভাই আহসান হাবীব রম্য সাহিত্যিক এবং কার্টুনিস্ট। তাঁর তিন বোন হলেন সুফিয়া হায়দার, মমতাজ শহিদ, ও রোকসানা আহমেদ।
তাঁর রচিত আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে জানা যায় যে, ছোটকালে হুমায়ূন আহমেদের নাম রাখা হয়েছিল শামসুর রহমান, ডাকনাম কাজল। তাঁর পিতা (ফয়জুর রহমান) নিজের নামের সাথে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন শামসুর রহমান। পরবর্তীতে আবার তিনি নিজেই ছেলের নাম পরিবর্তন করে হুমায়ূন আহমেদ রাখেন।
হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন এবং প্রথম শ্রেণীতে বিএসসি (সম্মান) ও এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে যোগদান করেন।
অধ্যাপক হিসাবে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে লেখালেখি এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বার্থে অধ্যাপনা ছেড়ে দেন।
হুমায়ূন আহমেদ স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন বই পড়ার পাশাপাশি জাদু’র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরেন এবং বিভিন্নজনের কাছ থেকে জাদু শিখতে থাকেন। কলেজে পড়াকালীন তিনি জাদুবিদ্যার প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁকে পরেন। বিভিন্ন জাদুকরের কাছ থেকে জাদু শিখেন এবং জাদুর সরঞ্জামাদি কেনেন। বন্ধুুমহলে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও জাদু প্রদর্শন করেন এবং যাদুশিল্পী হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন যাদুশিল্পী হিসেবে তাঁর নাম-ডাক ছড়িয়ে পরে। ১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম টিভিতে (তৎকালীন পিটিভি) জাদু প্রদর্শন করেন। জনপ্রিয় লেখক হওয়ার আগেই তিনি ছিলেন জনপ্রিয় যাদুশিল্পী। ‘যাদুশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ’ এই নামে তাঁকে নিয়ে একটি বইও লেখা হয়েছে, লিখেছেন আরেক যাদুশিল্পী এম এ জলিল। হুমায়ূন আহমেদ ভালো ছবিও আকতেন।
হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে। তার রচিত উল্লেখযোগ্য উপন্যাসসমূহর মধ্যে- শঙ্খনীল কারাগার, তোমাদের জন্য ভালোবাসা, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, শ্যামল ছায়া, মধ্যাহ্ন, মাতাল হাওয়া, লীলাবতী, কবি, বাদশাহ নামদার, নিশীথিনী, ময়ূরাক্ষী, নিষাদ, অন্য ভুবন, বৃহন্নলা, দেবী, আমার আছে জল, দারুচিনি দ্বীপ, প্রিয়তমেষু, নিরন্তর, সাজঘর, সম্রাট, আকাশ জোড়া মেঘ, দ্বৈরথ, এইসব দিনরাত্রি, অয়োময়, বহুব্রীহি, নীল অপরাজিতা, কোথাও কেউ নেই, পাখি আমার একলা পাখি, জলপদ্ম, আয়নাঘর, কৃষ্ণপক্ষ, জনম জনম, তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে, জল জোছনা, তিথির নীল তোয়ালে, ছায়াবীথি, যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ, গৌরীপুর জংশন, পেন্সিলে আঁকা পরী, কবি, জলকন্যা, দূরে কোথায়, রুমালী, মেঘ বলেছে যাব যাব, কালো যাদুকর, রূপার পালঙ্ক, বৃষ্টি বিলাস, নীল মানুষ, আসমানীরা তিন বোন, অচিনপুর, আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি, রোদনভরা এ বসন্ত, নক্ষত্রের রাত, এই বসন্তে, অমানুষ, নির্বাসন, সবাই গেছে বনে, মাতাল হাওয়া, রূপা, ম্যাজিক মুনশি, মেঘের ওপর বাড়ি, আগুনের পরশমণি, দেয়াল, হিমু, মিসির আলী, জোছনা ও জননীর গল্প, ইত্যাদি অন্যতম ।
হুমায়ূন আহমেদ এক সময় টেলিভিশনের জন্য নাটক লিখতে থাকেন এবং পরবর্তিতে নাটক নির্মাণ শুরু করেন।টেলিভিশনের জন্য তাঁর প্রথম নাটকের নাম 'প্রথম প্রহর', এটি ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়, নাটকটি পরিচালনা করেন নওয়াজিশ আলি খান। তাঁর লেখা ও নির্মাণ করা নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- অসময়, অযাত্রা, বিবাহ, এসো নিপবনে, নিমফুল, এইসব দিনরাত্রি, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়, আজ রবিবার, খেলা, অচিন বৃক্ষ, খাদক, একি কান্ড, একদিন হঠাৎ, অন্যভুবন, হাবলঙ্গের বাজার, অনাথ বাবুর ভয়, বৃক্ষ মানব, শওকত সাহেবের গাড়ি কেনা, চন্দ্র কারিগর, গণি সাহেবের শেষ কিছু দিন, লীলাবতী, জুতা বাবা, আজ জড়ির বিয়ে, খোয়াব নগর, পিশাচ মকবুল, জলতরঙ্গ, এই বর্ষায়, জিন্দা কবর, তাঁরা তিনজন, ২৪ ক্যারাট ম্যান, উড়ে যায় বকপক্ষী, কালা কইতর, সেদিন চৈত্রমাস, নক্ষত্রের রাত, অচিন রাগিনী, রুপালী রাত্রি, ওপেনটি বায়োস্কোপ, ইবলিশ, আগুন মজিদ, এই বর্ষায়, নগরে দৈত্য, হিমু, রুপা, লীলাবতীর মৃত্যু, যমুনার জল দেখতে কালো, জলে ভাসা পদ্ম, তিন প্রহর, মায়াবতী, খোয়াব নগর, চোর, প্রভৃতি।
হুমায়ূন আহমেদের সব নাটকই তুমুল দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর কিছু কিছু নাটকতো জনপ্রিয়তার চরম শীর্ষে ছিল, যা টেলিভিশন নাটকের জগতে ইতিহাস হয়ে আছে।
হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রই, শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র’সহ আটটি বিভাগে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’ লাভ করে। তার নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রগুলো হলো- শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, শ্যামল ছায়া, চন্দ্রকথা, আমার আছে জল, নয় নম্বর বিপদ সংকেত ও ঘেটু পুত্র কমলা।
হুমায়ুন আহমেদ কিছু গান লিখেছেন যা দর্শকশ্রোতা কর্তৃক সমাদৃত হয়েছে। তাঁর লেখা জনপ্রিয় গানসমূহের মধ্যে-
একটা ছিল সোনার কন্যা..., বরষার প্রথম দিনে..., মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ...., ও আমার উড়াল পঙ্খীরে..., চাঁদনী পসরে কে আমারে স্মরণ করে...., চল বৃষ্টিতে ভিজি..., যদি মন কাঁদে তুমি চলে এস এক বরষায়..., আমার ভাঙ্গা ঘরে ভাঙ্গা চালা ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে..., ও কারিগর দয়ার সাগর ওগো দয়াময়...., নদীর নাম ময়ূরাক্ষী...., অন্যতম।
হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বাংলা কথাসাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৩ সালে লেখক শিবির পুরস্কার লাভ করেন। বাংলা উপন্যাসে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৮১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান, এছাড়া তিনি বাংলাদেশ শিশু একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৭ সালে, মাইকেল মধূসুদন পদক লাভ করেন। ১৯৯০ সালে, হুমায়ূন কাদির স্মৃতি পুরস্কার পান, তিনি জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদক লাভ করেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ১৯৯৪ সালে দেশের দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে।
ব্যাক্তিজীবনে হুমায়ূন আহমেদ ১৯৭৩ সালে, গুলতেকিন খান-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির তিন মেয়ে এবং এক ছেলে। বড় মেয়ে নোভা আহমেদ, মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ এবং ছোট মেয়ে বিপাশা আহমেদ। তাঁর বড় ছেলের নাম নুহাশ হুমায়ুন। ২০০৫-এ গুলতেকিনের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয় এবং ঐ বছরই অভিনেত্রী শাওনকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাদের তিন ছেলে-মেয়ে জন্মগ্রহণ করে। প্রথম ভূমিষ্ঠ কন্যটি মারা যায়, যার নাম ছিলো লীলাবতী, আর ছেলে দু'জনের নাম নিষাদ হুমায়ূন ও নিনিত হুমায়ুন।
হুমায়ুন আহমেদ। একজন ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, যাদুশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক । বাংলাদেশের সাহিত্যভুবনে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব তিনি । জনপ্রিয়তার তুঙ্গস্পর্শী লেখক। তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস পেয়েছে তুমুল জনপ্রিয়তা, তরুণপাঠক সৃষ্টিতে রেখেছে অনন্য অবদান।
তাঁর সৃষ্ট ‘হিমু’ এবং ‘মিসির আলি’ চরিত্রগুলো বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদেরকে গভীরভাবে বিমোহিত করেছে, উদ্বেলিত করেছে। বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশে সর্বাধিক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হুমায়ুন আহমেদ, চিরঅমলিন-চিরঞ্জীব। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই এই দিনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। গুণী ব্যক্তিত্বের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা।



No comments