মানুষ -- ভিন্ন চোখে মানুষের গল্প || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১৩
পরদিন খুব সকালে টুকি ঘুম থেকে উঠে ফান্টুশ হোটেলের আশেপাশে
ঘোরাঘুরি করছিল। ওর বন্ধুরা তখনও আসেনি। গত রাতে টুকি ঘুমাতে পারেনি। সারারাত
বালির মধ্যে গড়াগড়ি করেছে, এপাশ থেকে ওপাশ ফিরেছে, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখেছে।
প্রিপারেশন নিয়েছে কিভাবে সে প্রপোজ করবে। তার ক্রাশ কি ধরনের উত্তর দিতে পারে
এবং সেই উত্তরের আবার কেমন উত্তর হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে একটা সমস্যা হলো
কোন কথার পরে কোন কথা বলবে কিছুই সে মনে রাখতে পারছে না। আর তারপর যদি তার ক্রাশটা
সামনে আসে তাহলে সে যে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলবে সেটা নিশ্চিত। তাতে অবশ্য
সমস্যা নেই। এটা প্রেমে পড়ার লক্ষণ। প্রেমে পড়ে সবাই সোজা কাজ উল্টাপাল্টা করে
ফেলে। টুকি হঠাৎ দেখলো তার ক্রাশ যে মানুষদের সাথে এসেছে তাদের সাথে হোটেল থেকে
বেরিয়ে সমুদ্র পাড়ের দিকে যাচ্ছে। ক্রাশের গলায় একটা দড়ি ঝুলছে। দড়ির আরেক
প্রান্ত একটা মানুষের হাতে যার কোলে বসেই সে জেটিঘাট থেকে ফান্টুস হোটেলে এসেছিল।
টুকি ওদেরকে অনুসরণ করা শুরু করলো। সুযোগ খুঁজছে তার ক্রাশের সাথে কথা বলার জন্য।
তার ক্রাশ অবশ্য এটা বুঝতেও পেরেছে। টুকি ওই মানুষদের থেকে একটু দূরে দূরে হাঁটছে
আর তার ক্রাশের দিকে তাকাচ্ছে। ক্রাশের সাথে তার বেশ কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছে।
আর তাতেই তো টুকির মনে লাড্ডু ফাটছে। ওই মানুষগুলো বীচের একটা বেঞ্চে বসলো। পাশে
সেই ফরেন।
: তুমি মনে হচ্ছে আমাকে কিছু বলতে চাও? কাল থেকেই দেখছি আমার পেছনে
ঘুরঘুর করছো।
টুকি : তুমি বুঝলে কি করে আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই?
: ছেলেদের চোখের ভাষা বুঝি বলেই তো আমরা মেয়ে।
টুকি : আমি একটু তোমার কাছাকাছি আসি?
: ভুলেও এসো না। তাহলে আমার সাথের মানুষগুলো গতকাল রাতের মত তোমাকে
দৌঁড়ানী দেবে। দূর থেকেই কথা বলো। আমি উত্তর দিচ্ছি।
টুকি : মনের কথা তো আস্তে আস্তে বলতে হয়। জোরে বললে তো সবাই শুনে
ফেলবে।
: আরে বোকা, মানুষেরা তো আমাদের কথা বুঝবে না।
কি বলো? তাই নাকি! - টুকি অবাক হয়ে গেলো।
: হ্যাঁ তো।
তাহলে ওদের সাথে তুমি কথা বলো কি করে? - প্রশ্ন করলো টুকি।
: ওদের কথা আমি বুঝি। আর ওরা আমার ইশারা বোঝে। আমার কথা বোঝে না।
যাক, তাহলে তো বেশ হলো। তবে এটা যদি কালকেই জানতাম তাহলে তো তোমার
কাছে যাওয়ার জন্য ওই দৌঁড়ানিটা খেতাম না। গেটের বাইরে থেকেই যখন তোমার সাথে
চোখাচোখি হচ্ছিল তখনই গল্প শুরু করতাম। - হাসতে হাসতে উত্তর দিলো টুকি।
: আমি তো গল্প শুরু করতেই চেয়েছিলাম। তুমি তো অস্থির হয়ে
গিয়েছিলে। অস্থির হয়ে আমার কাছে আসতে গেছো।
তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে। - হঠাৎ প্রশ্ন করলো টুকি।
: না নেই। আমি যেই মানুষদের সাথে থাকি ওরা এটা পছন্দ করেনা। তবে
ওরা কয়েকবার আমাকে বীট দিতে নিয়ে গেছে।
ওখানে কি হয়? - প্রশ্ন করলো টুকি।
: মেন্টাল এন্ড ফিজিক্যাল স্যাটিসফেকশন।
আমাকে নেবে ওখানে? - খুব করে আবদার করলো টুকি।
: এই সমুদ্র পাড়েই তুমি যে মেন্টাল আর ফিজিক্যাল স্যাটিসফেকশন
পাবে তা সেখানে পাবে না। ওখানে যা হয় সব সময় নিজের মনের মত হয় না। আমাদের মালিকরা
আমাদের জন্য পার্টনার ঠিক করে। তারপর তাদের সাথে আমাদের ক্লোজ হতে নিয়ে যায়। এসব
পার্টনারকে বয়ফ্রেন্ড না বলে জাস্ট ফ্রেন্ডও বলতে পারো।
এটা ভেবে ভালো লাগলো তোমার বয়ফ্রেন্ড নেই। - টুকি কিছু বুঝছে না,
তাই প্রসঙ্গ বদলালো।
: কেন? থাকলে কি হতো?
টুকি : থাকলে আমি খুব কষ্ট পেতাম।
: তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও? বলো তো সত্যি করে।
জেটি ঘাটে তোমাকে যখন প্রথম দেখেছি তখনই আমি তোমার প্রেমে পড়েছি।
বলতে পারো লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। - উত্তর দিলো টুকি।
: বুঝলাম। তবে আমি কেন?
প্রেমে পড়তে তো বছরের পর বছর লাগে না। এক মুহূর্তেই প্রেমে পড়া
যায়। আর প্রেমে পড়তে নির্দিষ্ট কোন কারণ লাগে না। সবাই আগে প্রেমে পড়ে। তারপর
প্রেমের সময়টাকে সুন্দর করে। তুমি রাজি থাকলে আমাদের প্রেমের সময়টাকেও আমি সুন্দর
করবো। - বললো টুকি।
: এর আগেও অনেক প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছি। তোমার প্রোপোজটা নতুন
কিছু না। তবে তুমি অনেক গুছিয়ে প্রোপোজ করেছো।
আচ্ছা তুমি কোন দেশের? কোন জাতের? - প্রশ্ন করলো টুকি।
: আমি জার্মান স্পিজ জাতের।
এটা কোথায়? - আবারো প্রশ্ন করলো টুকি।
: আরে বোকা এটা একটা দেশ। আমি সেই দেশ থেকে এই দেশে এসেছি।
বলো কি? তাই নাকি? তার মানে তুমি প্লেনে উঠেছো? প্লেন দেখতে কেমন?
যখন উপর দিয়ে ওড়ে তোমার ভয় করে না? সমুদ্র পাড়ে বসে আমি প্রায়ই আকাশে প্লেন
উড়তে দেখি আর ভাবি ইস আমি যদি একদিন উঠতে পারতাম। - নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো
না টুকি।
: না, আমি কখনো উঠিনি। তবে আমার পূর্বপুরুষরা উঠেছে। অনেক অনেক বছর
আগে আমার পূর্বপুরুষরা কোনো না কোনো মানুষের সাথে এই দেশে এসেছিল। আমি তাদেরই বংশ।
টুকি : তুমি কি আমার বন্ধু হবে?
: আমাকে তোমার বন্ধু বানাতে চাও? নাকি প্রেমিকা বানাতে চাও? তোমার
আসল উদ্দেশ্য কি বলতো।
বন্ধু হয়ে বোঝাপড়া, তারপর না হয় প্রেম। তারপর বিয়ে করে সুখের
একটা সংসার। - উত্তর দিলো টুকি।
: আমাকে বিয়ে করে রাখবে কোথায়?
কেন? আমি যেখানে থাকি। আমার ঘর কেমন জানো? সামনে বিশাল সমুদ্র আর
বালির ভিতর গর্ত করে আমি আমার ঘর বানিয়েছি। - উত্তর দিলো টুকি।
: কিন্তু আমার যে বালিতে এলার্জি। আমি যে গরম সহ্য করতে পারি না।
তাহলে তুমি থাকো কোথায়? - প্রশ্ন করলো টুকি।
: আমি যেই মানুষটার সাথে থাকি ওর রুমে এসি আছে। আর আমি ওর সাথে ওর
বিছানায়, ওর কম্বলের ভিতরে ঘুমাই।
এসি কি জিনিস? - টুকি যেন অবাক হয়ে যাচ্ছে।
: এসি দিয়ে ঘর ঠান্ডা করে। আমি বেশি গরম সহ্য করতে পারি না।
তাইলে আমিও তোমার জন্য এসি লাগাবো। আমি যেখানে থাকি তার পাশে একটা
বড় নারকেল গাছ আছে। একটা বড় এসি গাছে ঝুলিয়ে রাখবো। তাহলে তোমার আর গরম লাগবে না।
আচ্ছা, এসি দেখতে কেমন হয়? - বললো টুকি।
: বুঝেছি তুমি প্রেমে পড়েছো। তাই ভুলভাল বকছো। তুমি আমার জন্য এসি
কিনবা কিভাবে? আর কিনলেও লাগাবা কোথায়? গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখবা?
আচ্ছা শোনো না, আমি না তোমার জন্য একটু কেক এনেছি। গতকাল
পেয়েছিলাম। তোমাকে কেক দিয়ে প্রপোজ করবো বলে আমি না খেয়ে রেখে দিয়েছি। - নিজের
ভালোবাসা প্রকাশের চেষ্টা করলো টুকি।
: কিন্তু আমি তো কেক খেতে পারবো না।
কেন? তুমি কেক পছন্দ করো না? - জানতে চাইলো টুকি।
: পছন্দ তবে তুমি যেটা এনেছো সেটা নিশ্চয়ই নষ্ট হয়ে গেছে। আমার
তো নষ্ট খাবার শ্যুট করে না। আমি তো খাই ড্রাইফুড, সুপারশপের প্যাকেট খাবার,
ব্রকলি, সেদ্ধ খাবার। ইস্ট, ময়দা, মশলা দেওয়া খাবার আমার হেলথের জন্য ক্ষতিকর। তাই
আমার মালিক আমাকে খেতে দেয় না। আমি খুব দামী দামী আর পুষ্টিকর খাবার খাই।
এটা আবার কি খাবার? - অবাক হয়ে আবারো প্রশ্ন করলো টুকি।
: এটা তোমরা যারা রাস্তায় থাকো তাদের জন্য না। এটা আমার মত যারা
রিচ কিড, তাদের খাবার।
তাহলে এই কেকটা কি করবো? - প্রশ্ন করলো টুকি।
: তুমি খেয়ে ফেলো, এই কেক খেলে আমার পেট খারাপ করবে।
আমি সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। - আবারো নিজের মনের কথা
বললো টুকি।
: তোমার অনুভূতি আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি ভাবো তো তোমার সাথে
কি কখনো আমার মিল হওয়া সম্ভব? আমার অবস্থান আর তোমার অবস্থান একটু ভেবে দেখো।
টুকি : কি ভাববো?
: আমি কোথায় থাকি আর তুমি কোথায় থাকো? আমি কি খাই আর তুমি কি
খাও? আমাদের দুজনের ভিতরে অনেক তফাৎ। আমাদের মিল অসম্ভব।
টুকি : আচ্ছা তোমার নাম কি?
- কিও পেট্রা। তোমার নাম কি?
আমার নাম টুকি। - উত্তর দিলো টুকি।
কিও পেট্রা : তোমার নামটা সুন্দর।
তোমার নামটাও সুন্দর ঠিক তোমার মত। - বললো টুকি।
আমার রূপের রহস্য কি জানো? - প্রশ্ন করলো কিও পেট্রা।
কি? - পাল্টা প্রশ্ন করলো টুকি।
আমাকে যে মানুষটা পোষে, সেই মানুষটা আমাকে অনেক আদর করে। আমার জন্য
অনেক কসমেটিক্স কেনে। - উত্তর দিলো কিও পেট্রা।
কসমেটিকস কি? - প্রশ্ন করলো টুকি।
সাবান, শ্যাম্পু, তেল, কন্ডিশনার। এসব। - উত্তর দিলো কিও পেট্রা।
তুমি এইসব মাখো! - অবাক হয়ে গেলো টুকি।
হ্যাঁ। আমি তো এগুলো ছাড়া গোসল করতে পারি না। - উত্তর দিলো কিও
পেট্রা।
সমুদ্রে বেড়াতে এসে সমুদ্রে গোসল করবে না? চলো একটু না হয় একসাথে
ভিজি। - বললো টুকি।
না। সমুদ্রের পানিতে অনেক ময়লা থাকে। মানুষ সমুদ্র একদম নোংরা
বানিয়ে ফেলেছে। আবার ককনো আসরে তখন মনে হয় এই নোংরা দ্বীপের নোংরা গন্ধে আমি মরেই
যাবো। ময়লা আমি একদম সহ্য করতে পারি না। - উত্তর দিলো কিও পেট্রা।
তোমার লাইফ স্টাইল অনেক দামী, তাই না? - জানতে চাইলো টুকি।
তা বলতে পারো। এ যেমন তোমরা পচা বাঁশি খাবার খেয়ে বেঁচে আছো। তবে
আমি কোনো কম দামি খাবার খেতে পারি না। তোমরা সারাদিন সমুদ্রে ঝাঁপাঝাঁপি করলেও
কিছু হয় না। কিন্তু আমি সেটা পারবো না। তোমরা ময়লা বালিতে ঘুমাও। আর আমার
এসি, বেড, কম্বল না হলে ঘুম আসে না। - উত্তর দিলো কিও পেট্রা।
জানো আমার চারটা বন্ধু আছে। ইকি, তাহি, ইশি, গুলু। আমরা পাঁচজন
সবসময় একসাথে ঘুরি। - বন্ধুদের কথাও জানালো টুকি।
কিও পেট্রা : কাল তোমার সাথে যারা দৌঁড়ে পালিয়েছিল ওরা তোমার
বন্ধু?
টুকি : হ্যাঁ। আচ্ছা একটা কথা বলি?
কিও পেট্রা : বলো।
জাকিরের দোকানের বাক্স টিভিতে দেখেছি বড়লোক প্রেমিকা তার বাবার সব
কিছু ছেড়ে গরিব প্রেমিকের কাছে চলে আসে। তাহলে তো তুমিও আমার কাছে আসতে পারো।
তোমাকে আমি আমার রাজ্যের রানী বানিয়ে রাখবো। - বললো টুকি।
এসব সিনেমাতেই হয়। বাস্তবে হয়না। - উত্তর দিলো কিও পেট্রা।
তুমি সিনেমা দেখো? - প্রশ্ন করলো টুকি।
হ্যাঁ দেখি। - উত্তর দিলো কিও পেট্রা।
তোমার প্রিয় বাংলা সিনেমা কোনটা? - আবারো প্রশ্ন করলো টুকি।
আমি তো বাংলা সিনেমা দেখি না। আমি সাউথ ইন্ডিয়ান বা হলিউড এসব
দেখি। আমি যেই মানুষটার সাথে থাকি তার রুমে একটা বিশাল বড় টিভি আছে। - উত্তর দিলো
কিও পেট্রা।
টুকি : ওহ, আমরা জাকিরের দোকানে যেটা দেখি ওটা একটা বাক্সের মত ছোট
একটা টিভি। ঝিরঝির করে।
কিও পেট্রা : তোমার সাথে প্রেম করলে তুমি আমার কোনো শখ আহ্লাদ পূরণ
করতে পারবে না। যদি আমি তোমার প্রেমে পড়তাম তাহলে না হয় নায়িকাদের মত সবকিছু
ছেড়ে চলে আসতাম। কিন্তু আমি তো তোমার প্রেমে পড়িনি। তুমি আমার প্রেমে পড়েছো।
কিন্তু তোমার ভাগ্য এতই খারাপ তুমি তোমার সব কিছু ছেড়ে আমার কাছে আসতে পারবে না।
টুকি : তাহলে কি করবো বলো?
কিও পেট্রা : কি আর করবা, সমুদ্র পাড়ে দাঁড়িয়ে যেভাবে আকাশের
প্লেন দেখো, আমি ঠিক তেমনই। আমাকে ছোঁয়া যায় না, কল্পনা করা যায়।
টুকি : সেদিন একটা বাংলা সিনেমা দেখছিলাম। নায়িকার বাপে নায়করে
বলছিল বামন হয়ে আকাশের চাঁদ ধরতে যেও না। তুমি কি আমাকে সেটা বললে?
কিও পেট্রা : তোমাকে মূর্খ, বোকাসোকা ভেবেছিলাম। তবে তুমি চালাক
আছো। বুঝতে পেরেছো আমি তোমাকে কি বলতে চেয়েছি।
তুমি আমাকে অপমান করলে? - প্রশ্ন করলো টুকি।
কিও পেট্রা : অপমান না টুকি। তোমাকে আমি বাস্তবতা বুঝালাম। বাস্তবে
তোমার আর আমার মাঝে অনেক দূরত্ব। তুমি আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারো। স্বপ্নে
সংসার করতে পারো। তবে সেটা কি বাস্তবে সম্ভব বলো? আমি এখানে দুদিনের জন্য বেড়াতে
এসেছি। বেড়িয়ে চলে যাবো। যখন খুব খারাপ লাগবে তখন হয়তো ইশারায় মালিককে বোঝালে সে
আমাকে তার পছন্দমত কোথাও বীট দিতে নিয়ে যাবে। এটা আমার জীবনের রেগুলার রুটিন। আমি
এটাতেই অভ্যস্ত। আর সময় নষ্ট করো না। তুমি তোমার পথে যাও। আমার পেছনে ঘুরে সময়
নষ্ট করো না। ভালো থাকো।
টুকি : আমি তো তোমাকে নিয়ে ভালো থাকতে চেয়েছিলাম কিও পেট্রা।
কিও পেট্রা : সবার সব ইচ্ছে কি পূরণ হয় বলো? এই যেমন আমি আমার
মাদারল্যান্ডে যেতে চাই, সেটা কি সম্ভব বলো?
টুকি : তাহলে এই কেকটা কি করবো?
তোমাদের এখানে এমনিতেই খাবারের অনেক অভাব। রাগ করে নষ্ট করে ফেলো
না। এর থেকে নিজে খেয়ে ফেলো। - এই বলে বিদায় নিলো কিও পেট্রা।
টুকি জাকিরের দোকানের বাক্স টিভির একটা কষ্টের গান ভাবতে ভাবতে
সমুদ্রের পানিতে গা ভেজাচ্ছে। ওর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সেই নোনাপানি ধুয়ে যাচ্ছে
সমুদ্রের নোনা পানিতে। বুক ভরা কষ্ট চাপা দিয়ে সমুদ্রের পাড় ধরে কাঁদতে কাঁদতে সে
তার বন্ধুদের কাছে আসলো। তার মাথায় যেন আকাশের প্লেন ভেঙে পড়ছে। তার সব স্বপ্ন,
সব আশা এক নিমিষেই সমুদ্রপাড়ের বালুতে মিশে গেল। নিজের কাছে নিজের জীবনকে খুব
মূল্যহীন মনে হচ্ছে।
কি হয়েছে রে তোর? তোর চোখ লাল কেন? ঘুম হয় নাই রাতে? - জানতে
চাইলো তাহি।
রাতে ঘুম হয়নি এটাও ঠিক। তবে আর যে ঠিক করে ঘুমাতে পারবো না সেটাও
ঠিক। - উত্তর দিলো টুকি।
তোর সেই ক্রাশের কি খবর? তাকে প্রপোজ করতে যাবি বলে আমরা তোর জন্য
বসে আছি। তোরই কোনো খবর নেই। - বললো গুলু।
তার আর দরকার নেই বন্ধু। - থামিয়ে দিলো টুকি।
কেন? কি হয়েছে? তোর ক্রাশ কি আবার বদলে গেছে? নতুন কাউকে
পছন্দ হয়েছে? - প্রশ্ন করলো ইকি।
না বন্ধু। সকালে ওর সাথে দেখা হয়েছিল। কথা হয়েছে। - বন্ধুদেরকে
জানালো টুকি।
কি কথা? - প্রশ্ন করলো ইশি।
ওর নাম কিও পেট্রা। অনেক বড়লোক ফ্যামিলিতে থাকে। গরম সহ্য করতে
পারে না, এসি ছাড়া ঘুমাতে পারে না, নরম বিছানা গায়ে কম্বল ছাড়া ঘুমাতে পারে না,
পচা বাঁশি খাবার খেতে পারে না, ওর রুমে নাকি বিশাল বড় একটা টিভি আছে। - বললো
টুকি।
বলিস কি? এ তো রীচ কিড। - যোগ করলো গুলু।
হ্যা রে বন্ধু। জানিস ওরে আমার ভাগের কালকের কেকটাও দিছিলাম। সে
নেয় নি। এই খাবার খেলে নাকি ওর পেট খারাপ করবে। তাই আমারেই খেয়ে নিতে বলছে। -
একে একে নিজের কষ্টের কথা বলছে টুকি।
আর কি বলেছে? - জানতে চাইলো ইকি।
বলেছে ওর আর আমার মাঝে অনেক দূরত্ব। আমাদের দুজনের মিল হওয়া কখনো
সম্ভব না। - বললো টুকি।
কেন সিনেমায় তো দেখি বড়লোক প্রেমিকা বাপের সব কিছু রেখে গরীব
প্রেমিকের কাছে চলে আসছে। তাহলে সে আসবে না কেন? - বললো তাহি।
বন্ধু তাকে আমি ঠিক এই উদাহরণটাই দিছিলাম। সে কি বলে জানিস? সে বলে
এসব কাহিনী সিনেমাতেই ভালো লাগে। আর সে তো বাংলা সিনেমা দেখে না। সে নাকি দেখে
সাউথ ইন্ডিয়ান, হলিউড এইসব সিনেমা। শেষমেষ রিকুয়েস্ট করছি আমার সাথে একটু
সমুদ্রে ভিজতে। - যোগ করলো টুকি।
তারপর সে কি বললো? - প্রশ্ন করলো ইশি।
সে বললো সমুদ্রের নোংরা পানিতে সে গোসল করবে না। তার গোসল করতে
নাকি সাবান, শ্যাম্পু, তেল, কন্ডিশনার এইসব লাগে। - উত্তর দিলো টুকি।
সাবান, শ্যাম্পু তো সারা জীবন জাকিরের দোকানে ঝুইলা থাকতেই দেখছি
নিজেরা কখনো মেখে দেখতে পারলাম না। - আফসোস করে উত্তর দিলো গুলু।
আর কিও পেট্রা নাকি প্রতিদিন এই সাবান, শ্যাম্পু, তেল, কন্ডিশনার
দিয়েই গোসল করে। - বললো টুকি।
থাক, যা গেছে, গেছে। কষ্ট পাস না। আরে এসব কত আসবে যাবে। - বন্ধুকে
সান্ত্বনা দিলো গুলু।
আমার কাছে কিও পেট্রা একজনই বন্ধু। আমি এখনো ওর প্রেমে হাবুডুবু
খাচ্ছি। - যোগ করলো টুকি।
তোর অবস্থান আর তার অবস্থান ভাব। তাইলে আর হাবুডুবু খাবি না। -
বললো ইকি।
সে আমাকে কি বলেছে জানিস? সে বলেছে আমি নাকি বামন হয়ে আকাশের
চাঁদের দিকে হাত বাড়াইছি। - যোগ করলো টুকি।
আরে এই ডায়লগটা তো সেদিন নায়িকার বাপে নায়করে দিছিল। তাই না? -
বললো তাহি।
থাক আর খোঁচা দিস না বন্ধু। আমি আর নিতে পারছি না। - তাহিকে থামিয়ে
দিলো টুকি।
আচ্ছা বাদ দে। তোর ক্রাশ তোর সাথে সমুদ্র ভিজতে চাই নাই তো কি
হয়েছে, আমরা আছি তো। বন্ধু থাকলে আর কি লাগে? চল তোর সাথে আমরা সবাই সমুদ্রে
ভিজবো, সমুদ্র লাফালাফি করবো। সব সময় ক্রাশ, প্রেমিকাকে কেন থাকতে হবে? বন্ধু
থাকলেই তো জীবন সুন্দর। এই বলে সবাই টুকিকে ধরে টানাটানি করে সমুদ্রে নামালো।
.png)


No comments