Header Ads

হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৭

শাহরিয়ার সোহাগ, story by Shahriar sohag, bangla poem pic, bangla poem, bangla love story, bangla sad story, bangla bosonto

: আমার বাবা ছিলেন মুদি দোকানি। সকালে যেতেন, রাতে আসতেন। আমার সাথে বাবার দেখা খুব কম হতো। তবে বাবা ওই মহিলার কাছে আমার নিয়মিত খোজ নিতেন। বাবা তো! সন্তানকে তো আর ছেড়ে যেতে পারেন না। তবে ডাইনিটা সব মিথ্যা বলত। আমি ঠিকমতো স্কুলে যেতে পারতাম না। আমাকেই বাড়ির সমস্ত কাজ করতে হতো। এমনি সৎ ভাইয়ের কাপড়ও পরিষ্কার করতে হতো আমাকে। ঠিকমতো খেতে পারতাম না তিনবেলা। তবে রাতে মাঝে মধ্যে বাবার সাথে খেতাম। কখনও আবার বাবা ফেরার আগেই ঘুমিয়ে পড়তাম। বাবা কাজ থেকে ফিরে আমার খোঁজ নিতেন। তিনি আমার কাছে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইতেন। তবে আমি বাবাকে বলতে পারতাম না যে আমি আর পারছি না। বাবা সবসময় হাসি মা বলে ডাকতেন।

আমি যখন এসএসসি পরীক্ষা দেই তখন আমার সৎ ভাই নাইনে পড়ত। আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট ছিল ও। আমার রেজাল্ট তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো আসত। কারণ আমি পড়ার খুব একটা সুযোগ পেতাম না। ছেলেটা যখন পড়ত আমি তখন রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম।

বাবার দ্বিতীয় বউ হয়তো বুঝতে পেরেছিল আমি বেশি পড়াশুনা শিখলে তার সমস্যা হবে। তাই আমি যখন কলেজে ভর্তি হতে চাচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে সে তার ছেলেকে লেলিয়ে দেয় আমার ওপর। একটা মায়ের পক্ষে কি এটা আদৌ সম্ভব? আমি তার মেয়ে না হলেও একটা মেয়ে কীভাবে আরেকটা মেয়ের সাথে করতে পারে এই নিষ্ঠুর ব্যবহার। আমি তখন আমার ঘরে ছিলাম। আমার ঘরটা ছিল ছোট্ট স্টোর রুম ধরনের। বাবা তখন বাসায় ছিলেন না। ছেলেটা হঠাত ঝাপিয়ে পড়ে আমার উপর। তখন তার বয়স মাত্র ১৪। আর আমার ১৬। সে আমার সতীত্ব নষ্ট করতে না পারলেও আমাকে সে সেদিন ক্ষতবিক্ষত করেছিল। তার সাথে আমি পেরে উঠছিলাম না। আমি চিৎকার করতে লাগলাম। তবে লাভ হলো না। কারণ বাহিরে সেই মহিলা ছাড়া আর কেউ ছিল না। আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে বেরিয়ে গেল আমার ঘর থেকে। আর আমি? ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় পড়ে রইলাম নিজের ঘরে। আমি বাবাকে কিছু বলতে পারি নি। তবে বাবা জেনেছিলেন। ভুল জেনেছিলেন। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ঘটনাটা ঘুরিয়ে বলে সম্পূর্ণ দোষ চাপিয়ে দেয় আমার ওপর। বাবা অবশ্য বুঝেছিলেন আমি নির্দোষ। তবে দ্বিতীয় স্ত্রীকে কিছু বলতে পারলেন না সংসার ভাঙার ভয়ে। আমার বিয়ের জন্য সৎ মা বাবাকে চাপ দিতে থাকেন। বাবাকে বোঝালেন আমাকে বিয়ে না দিয়ে দিলে আমার জন্য পরিবারের বদনাম হবে। আমার বাবার মোটামুটি ভালোই সম্পত্তি ছিল। আমি যদি বেশি শিক্ষিত হই বা বাড়িতে থাকি তাহলে সম্পত্তি বেহাত হতে পারে। একসময় আমার বিয়েটা সংসার ভাঙার কারণ হয়ে দাঁড়াল। মানে আমাকে বিয়ে না দিলে মহিলাটা তার বাবার বাড়ি চলে যাবে। বাবা আমার বিয়ে ঠিক করলেন। সেখানেও ডায়নীর হাত ছিল। নিজের দুঃসম্পর্কের এক লম্পট আত্মীয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করলো। বাবা চেয়েছিলেন তার হাসি মায়ের মুখ যেন না হারিয়ে যায়। পাত্র বাছাইয়ের জন্য বাবা দ্বিতীয় স্ত্রীর উপর ভরসা রেখেছিলেন। তবে ডায়নীটা সেই ভরসা ব্যবহার করেছে। বিয়ের প্রথম সাড়ে চারমাস ভালোই সংসার করলাম। তারপর হঠাত শ্বশুর বাড়ি থেকে যৌতুকের জন্য চাপ দিতে লাগলো। আমাকে বেশ কয়েকবার শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরও করে দেয়। আমি তখন বাবার বাড়ি আসতাম। তবে বাবাকে যৌতুকের কথা বলতে পারতাম না। কিছুদিন বাবার বাড়ি থেকে আবারও যেতাম শ্বশুর বাড়ি। তবে আমার এই বারবার বাড়িতে আসা সৎ মা আর সৎ ভাই ভালোভাবে নিত না। আমি এক সময় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাবাকে জানালাম যৌতুকের কথা। বাবা ৫০ হাজার টাকাও দিলেন। সেই সময়টা হলো যখন বিয়ের সাত মাসের মতো সময় পার হয়েছে। তার কিছুদিন পর বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। এদিকে আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা। জুয়ারি স্বামী সেই টাকা বেশিদিন রাখতে পারে নি। আবারও শুরু হলো আমার ওপর যৌতুকের নির্যাতন। তবুও বাচ্চার কথা ভেবে সয়ে গেছি সব নির্যাতন। এক সময় বাচ্চা হলো। মেয়ে। আমি আমার সৎমাকে জানাই যৌতুকের নির্যাতনের কথা। আর আমার প্রতি তার মন্তব্য ছিলজন্মের পর থেকেই কাঁদছিস, তাহলে এখন সুখের আশা করিস কীভাবে? আমি টাকা দিতে পারবো না। আমি আবার শ্বশুর বাড়ি ফিরে গেলাম। এভাবেই সদ্য বাচ্চা নিয়ে বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি ছুটতে থাকলাম। কোনো লাভ হলো না। শ্বশুর বাড়ির সবাই মিলে একদিন আমাকে খুব মারধর করলো। বের করে দিলো বাড়ি থেকে। বাবার বাড়িতেও আমার ঠাই হলো না। এদিকে আমার বাচ্চাটাও দিনে দিনে অসুস্থ হতে থাকে। বাচ্চার বয়স তখন দুই মাস। আমি বাচ্চাটাকে ঠিকমতো দুধ খাওয়াতে পারতাম না। খুব জ্বর হয় আমার সোনামণিটার। আমার বাড়ি ঢাকার কাছেই। শ্রীনগর। বাচ্চা নিয়ে কোথাও ঠাই না হওয়ায় চলে আসি ঢাকা। শুরু করি ভিক্ষা। বাচ্চা আর আমার বেঁচে থাকার আশায় বাচ্চা নিয়ে হাত পাততে থাকি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। বাচ্চার অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। একদিন একটু থেমে গেল হাসি।

কী? কী হলো ?

চোখ ভিজে আসলো হাসির। আর কৌতূহলী অর্ণের চোখমুখে কৌতূহল।

একদিন ভিক্ষা করতে যাই এক বাসায়। একটা বড় বিল্ডিং। ওয়ারীতে। একটা ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়তেই একটা ছেলে, বয়স এই সাতাশআটাশ হবে। আমার বয়স তখন আঠারো। এসে দরজা খুলল। আমি আমার করুণ অবস্থার কথা বলতেই সে বলল– “ভয় নেই, এই ফ্ল্যাটে একটা ডাক্তার আছে।সে আমাকে ফ্ল্যাটের ভেতরে যেতে বললো। বাচ্চাকে বাঁচাবার আশায় আমিও ঢুকলাম ফ্ল্যাটের ভেতর। তারপর

তারপর? তারপর কী?

: আমার গায়ের উপর ঝাপিয়ে পড়লো পিশাচটা। তারপর আমার বাচ্চাটাকে পাশে ফেলে দিয়ে আমার রক্তমাংস চুষতে লাগলো। আমাকে জোর করে উলঙ্গ করে কামড়াতে থাকলো আমার সারা দেহ। ক্ষতবিক্ষত করে দিলো আমার বুকের নরম হাড়গুলো। সত্যি, সত্যি অর্ণ, আমি সেদিন আপ্রান চেষ্টা করেছিলাম নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে। কিন্তু পারি নি। পিশাচটা আমাকে কুত্তার মতো ঠুকরাতে লাগলো। আমার সেই আর্তচিৎকার এই ঢাকার চার দেয়ালের মাঝে, কারও কানে সেই চিৎকার পৌঁছায়নি সেদিন। আমাকে ধর্ষণ করে অচেতন অবস্থায় ফেলে রাখল ফ্ল্যাটের মধ্যে। তারপর হয়তো সন্ধ্যার দিকে আমাকে আর আমার বাচ্চাকে ফেলে গেল রাস্তায়। জ্ঞান ফিরে আমি লাইনটা শেষ না করেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠল হাসি।

: কী হলো হাসি?

হা: আমি দেখলাম আমার সোনামণি আর নেই।

নেই মানে?

অঝোরে কেঁদে চলছে হাসি। হঠাত কেউ সেই হলুদ ল্যাম্পপোস্টের নিচে উপস্থিত হলে বুঝতে কষ্ট হবে তার নাম হাসি। কারণ সেই মুহূর্তে তার চেহারায় তার নামের সাথে কোনো সার্থকতা নেই। হাউমাউ করে হাসি কেঁদে দিলো নিজের সন্তানের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে। ক্ষণিকের জন্য অর্ণর মনে হলো হাসিকে সান্ত্বনা দেবে। তবে সে ভাবল হাসি, যার গায়ে হাত দেওয়া, যার মধু খাওয়া খুব সহজ ব্যাপার। একজন সভ্য মানুষ হিসেবে তার কি উচিৎ হবে একটা মেয়েকে একা পেয়ে তার দুর্বলতাকে পুঁজি করে তার গায়ে হাত দেওয়া? অর্ণ হাসির গায়ে হাত দিলো না। তাকে জড়িয়েও ধরলো না সান্ত্বনার ছলে। তবে কয়েকবার চোখের পানি মুছে দিয়ে তার দুঃখের ভাগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে মাত্র। অর্ণ অনেকবার হাসিকে না কাঁদতে অনুরোধ করেছিল। তবে সন্তান হারানোর হাহাকারের কাছে সেই অনুরোধ অর্থহীন। অর্ণর কিছু করার নেই শুধু সেই দিনের পিশাচদেরজানোয়ারবলে গালি দেওয়া ছাড়া। তবে অর্ণ কি সত্যিই চায় হাসিকে হাসাতে? নাকি হাসির নষ্ট সময়কে উপভোগ করতে চায়?

হাসি, তুমি শান্ত হও।এটা হাসিকে নামমাত্র সান্ত্বনা দেওয়া মাত্র।

: মরা বাচ্চা নিয়ে ভিক্ষা করে কাফনের টাকা জোগাড় করেছি। তারপর কবর দিই কিছু মানুষের সাহায্যে। অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছি। তবে পেরে উঠি না। পারবই বা কি করে? আমার ওপর তো সবার অভিশাপ রয়েছে।

: অভিশাপ?

: জন্মের পরেই আমি সবাইকে কাঁদিয়েছি। তাদের অভিশাপ। আমি খুব বেশি শিক্ষিত না হলেও অশিক্ষিত নই। আমি ইংরেজি ভাষা পছন্দ করিনা। কারণ ইংরেজি হলো বড়লোকদের ভাষা। যদিও আমার খদ্দের সব বড়লোক। সেইদিনের সেই ঘটনা, সন্তান হারানোকে জীবনের টার্নিং পয়েন্ট ভেবে সেটাকে ভুলে গিয়ে আবারও একা বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। এক মুঠো ভাত পাওয়ার এবং বেঁচে থাকার আশায় কাজ খুজতে থাকি। ভিক্ষার বীভৎসতা ভুলে কাজ নিই এক গার্মেন্টসে। আমি দেখতে তখন আরও সুন্দর ছিলাম। 


২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে বীর শহিদ ও অকুতোভয় আন্দোলনকারীদের স্মরণে ও সম্মানে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে শাহরিয়ার সোহাগ এর নতুন উপন্যাস বাংলা বসন্ত। অর্ডার করতে ক্লিক করুন

                                   

উপন্যাস : হলুদ বাতির হাসি 

লেখক : শাহরিয়ার সোহাগ 

প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা, ২০১৬।

এটা লেখকের ৩য় বই।


হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১  

হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ২  

হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৩  

হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৪  

হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৫  

হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৬  


হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৮ 

হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৯ 

হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১০ 

No comments

Powered by Blogger.