হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৮
তুমি তো দেখতে এমনিতেই সুন্দর। – হাসিকে একটু হাসানোর চেষ্টা করলো অর্ণ।
মুচকি একটা হাসি দিয়ে আবারও শুরু করলো হাসি। তবে সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী ছিল না। – চেহারা সুন্দর হওয়ায় নজরে পড়ি ম্যানেজারের। ম্যানেজার রাত–বিরাতে বিভিন্ন কাজের অজুহাতে আমাকে ডাকতো আর সুযোগ পেলেই আমাকে খামচাতো। আমি চাকরি হারানোর ভয়ে যেতাম। তবে বিশ্বাস করো অর্ণ, আমি মন থেকে যেতাম না। আমার মনে হতো যেই আমি যাচ্ছি সেটা আমি না, অন্য কেউ। আমি বহুবার ম্যানেজারের লালসার শিকার হয়েছি। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে চেয়েছিলাম উপরের স্যারদের কাছে বিচার দেব। কিন্তু সেই মুহূর্তে একদিন কাজে গিয়ে হঠাত শুনি আমার চাকরিটা নেই। ম্যানেজার জানোয়ারটা নিজের মানসম্মান বাঁচাতে আমাকে পথে বসালো। বেঁচে থাকার আশায়, এক প্লেট ভাতের আমার বাবার সেই ‘হাসি মা’ হয়ে গেল ‘হাসি সুন্দরী’। আর এখন কলগার্ল হাসি। মানে পতিতা হাসি, বেশ্যা হাসি। – কথাগুলো হাসি বলছিল হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে। কাঁদুক। হাসি কাঁদুক। কথায় বলে কাঁদলে নাকি কষ্টগুলো হালকা হয়। হাসি তো সবসময়ই হাসে। তাই কষ্টগুলো প্রকাশ পায়না। আজ যখন প্রকাশ পাচ্ছে পাক।
আমি দুঃখিত হাসি। আমি আর শুনতে চাই না। – হাসিকে থামানোর চেষ্টা করলো অর্ণ।
: আচ্ছা অর্ণ, তুমিই বলো, কোনো মেয়ে কি পতিতা, বেশ্যা উপাধিগুলো নিজের করে নিতে চায়? আচ্ছা, আমি কি কখনও ভেবেছি এমন এক সময় আসবে যখন আমার বেঁচে থাকার খাবার জোগাড় করতে খাবার হতে হবে মুখোশ পরা কুকুরগুলোর?
আজ হাসির ক্ষোভ এই সমাজের প্রতি। যাদের পশুসুলভ আচরণে হাসি আজ জর্জরিত। কাঁদছে হাসি। আর নিজে দোষী না হয়েও সেই পিশাচ সমাজের বাসিন্দা হওয়ায় অপরাধীর মতো হাসির পাশে বসে আছে অর্ণ। হঠাত হাসির মোবাইলটা বেজে উঠল। হাসি চোখ মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ ফোনে কথা বলে উঠে দাঁড়ালো হাসি। সাথে অর্ণও।
আমার যেতে হবে। – চোখ মুছে স্বাভাবিক হলো হাসি।
কোথায় যাবে তুমি? – জানতে চাইলো অর্ণ।
শুনলে না? কাস্টমার ফোন দিলো। যেতে হবে। – উত্তর দিলো হাসি।
: বলেছিলে যে আজ যাবে না।
টাকার নেশা তো। দেখি কত টাকা দেয়। – উত্তর দিলো হাসি।
: তাহলে কাজ শেষ করে এখানে আবার এসো। আমি এখানে সারারাত…। – অর্ণর কথা শেষ হতে না হতেই হাসি যাত্রা শুরু করলো তার গন্তব্যে, পরিচিত পেশায় অপরিচিত গন্তব্যে।
অর্ণ একা বসে আছে। মানুষের সবচেয়ে বড় আদালত হলো তার বিবেক। অর্ণ আজ সেই আদালতে মুখোমুখি। তার পক্ষে আর কী কিছুই করা সম্ভব না? কী ই বা করবে সে। তাহলে তারই বা কী করার আছে? তাহলে অর্ণ এতদিন কথাই বা বললো কেনো হাসির সাথে? সে আসলে কিসের প্রতি কৌতূহলী ছিল? তার পেশা নাকি তার দেহ সম্পর্কে? তার এই কৌতূহলী আলাপচারিতায় হাসির সময় নষ্ট হয়েছে ঠিকই, তবে এই সময় নষ্টের পিছনে অর্ণের লাভটা কী? বিভিন্ন প্রশ্ন, নানা কৌতূহল তাকে ঘিরে ধরেছে। তবে সে অসহায়। তার কিছু করার সামর্থ্য বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই। হায়রে রঙিন দুনিয়া! যার সাধ্য নেই তারই সাধ জাগে সাহায্যের। আর যাদের সাধ্য আছে হাসিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার, তারাই কোনো না কোনো রাতে হাসিকে নিয়ে যায় নিজেদের আয়েশের জন্য। তাহলে সমাজটা বদলানোর দায়িত্ব কে নেবে?
সময়টা ভোরের কিছু আগে। আবারও আগমন ঘটল হাসির। কারণ সে শুনেছিল অর্ণ সারারাত সেখানে থাকবে। এসে অর্ণের বামপাশে বসল নিঃশব্দে। হাসি তখন হাসিহীন। দৈনন্দিন পোশাকের সাথে হঠাত করেই একটা ওড়না, বুকটা ঢেকে রেখেছে ওটা দিয়ে।
হাসি? কখন এলে? –
লাফিয়ে উঠল অর্ণ।
এই মাত্র। – চুপচাপ উত্তর দিলো হাসি।
রাতে যখন গেলে তখনকার গেটাপ আলাদা আর এখনকার গেটাপ আলাদা লাগছে। – কথা বলার চেষ্টা করলো অর্ণ।
এক গেটাপে বেশিক্ষণ থাকলে আমার হবে নাকি? নতুন নতুন স্টাইলে নতুন নতুন কাস্টমার পাব। – উত্তর দিলো হাসি।
: না। তবুও কেমন জানি গম্ভীর লাগছে তোমায়। তোমার চাহনিটা কেমন জানি ভারী ভারী লাগছে।
কোনো উত্তর দিলো না হাসি। মানুষ অতিরিক্ত কাঁদলে বা আর্তনাদ করলে যেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। ঠিক তেমন লাগছে হাসির। আর হাসির এই হঠাত পরিবর্তন দেখে অবাক হল অর্ণ। হাসি ওর ওড়নাটা এমনভাবে জড়িয়েছে যেন অর্ণ দেখতে না পারে ওর বুকটা। অথচ হাসিই কিনা তার বুকটা বাড়িয়ে দিয়ে বহুবার চেষ্টা করেছে অর্ণের স্পর্শ পেতে। তাছাড়া হাসির মতো মেয়ের ক্ষেত্রে এটা অকল্পনীয়ও বটে। কারণ হাসি নিজেই অর্ণকে বলেছে খদ্দের প্রথমে তার হাসি আর বুক দেখে পছন্দ করে তার দেহ।
হাসি, তোমার কী হয়েছে? – অর্ণ বারবার প্রশ্ন করছে হাসিকে। তবে কোনো কথা বললো না হাসি। শুধু ওড়নাটা আরও সজোরে চেপে ধরলো বুকের সাথে, ডানপাশে বসে থাকা অর্ণ খেয়াল করলো হাসির চুল বামপাশে অনেক হেলানো। হাসি হয়তো চুল দিয়ে তার মুখমন্ডলের বামপাশটা ঢেকে রাখার মিথ্যে চেষ্টা করছে।
তোমার চুল দেখছি অন্য স্টাইলে । – হাসিকে একটু হাসানোর চেষ্টা করলো অর্ণ।
এবারও কোনো উত্তর দিলো না হাসি। হাসিকে সামান্য নাড়া দিতেই কেমন যেন ক্ষেপে উঠল হাসি। উঠে দাঁড়িয়ে সজোরে আর্তনাদ করলো। আর ততক্ষণে অর্ণ আবিষ্কার করেছে হাসির বাম কপালে ক্ষতের দাগ।
হাসি তোমার কপালে ক্ষত? কীভাবে হলো এটা? – অর্ণ চুলগুলো সরিয়ে ভালোভাবে বুঝতে চাইল ক্ষতটা। তবে হাসি তার হাত দিয়ে বাধা দিলো অর্ণকে। আর তাতেই নিজের বুকটা আর লুকিয়ে রাখতে পারল না হাসি। লুকিয়ে রাখতে পারল না বুকের ক্ষত, বুক থেকে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। রক্তে ওর বুক ভিজে লাল হয়ে গেছে।
: হাসি, তোমার বুকে রক্ত? কী হয়েছে তোমার?
কোনো উত্তর নেই হাসির সেই মায়াবী হাসি মুখে। হলুদ বাতির নিচে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে হাসি। তখনো সকাল হয়নি, সরকারি বাতিগুলো তখনো জ্বলছে। অর্ণের তখন কী করা উচিৎ? হাসিকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিবে? নাকি তার বুকের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হাসির বুকের ক্ষত জায়গাটা চেপে ধরবে নিজ হাত দিয়ে? যদিও হাসি এসবে অভ্যস্ত, তবুও একটা মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার বুকে হাত দেওয়াটা কি উচিৎ হবে অর্ণর? হতভম্ব হয়ে গেল অর্ণ। এটা কী কোনো মানুষের কাজ? হাসি কান্না ভরা চোখে আর্তনাদ। এটা কী করে সম্ভব? হাসি তো সবসময় হাসে।
উপন্যাস : হলুদ বাতির হাসি
লেখক : শাহরিয়ার সোহাগ
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা, ২০১৬।
এটা লেখকের ৩য় বই।
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ২
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৩
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৪
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৫
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৬
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৭



No comments