হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১
সময়কালটা খুব বেশি দিন আগের না। অর্ণ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের থার্ড ইয়ারের ছাত্র। অবশ্য এখনও তার অনার্স শেষ হয়নি। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে থাকে অর্ণ। গ্রামের বাড়ি ঢাকা থেকে বেশ দূরে। এই ছয়–সাত ঘন্টার জার্নি।
সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশুনা করায় যে কোনোকিছু সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় অর্ণের জানার কৌতূহল একটু বেশিই। ওর ই বা দোষ কী? সাংবাদিকতার ছাত্র তো, নতুনত্বের প্রতি টান তো থাকবেই। তখনো কেবল ছাত্র। কোনো পত্রিকাতেও ঢোকেনি।
ওদের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা ক্যাম্পেইন হবে হবে করে হচ্ছে না। ক্যাম্পেইনটার জন্য তাদের ঢাকার বাইরে থাকতে হবে সপ্তাহখানেকের জন্য। তবে নীতিনির্ধারকরা এখনও নির্দিষ্ট কোনো তারিখ বলছেন না। অর্ণ হলো তাদের ক্লাসের ক্যাপ্টেন। সবাইকে বলা হয়েছে প্রস্তুত থাকতে। যেকোনো দিন ক্যাম্পেইনের ডাক আসতে পারে। আর এমন মুহূর্তেই এক জরুরি প্রয়োজনে গ্রামে যেতে হলো অর্ণকে। অর্ণর দুঃসম্পর্কের এক বোনের বিয়ে। দুঃসম্পর্কের হলেও তাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা দারুণ। আসলে রক্তের সম্পর্কটাই আত্মীয় নয়, আত্মার সম্পর্কটাই আত্মীয়। অনেক আগেই অর্ণ তাদের কথা দিয়ে রেখেছিল যে, বিয়েতে সে অবশ্যই উপস্থিত থাকবে। অর্ণ হয়তো এটা জানতো না এমন সময় বিয়ের তারিখ ঠিক হবে যখন তার ঢাকা থাকা জরুরি। তবে কথা যখন দিয়েই ফেলেছে তখন সেটা খেলাপ করা ঠিক হবে না। তাই নিজের কষ্ট হলেও সকলের মন রাখতে হবে। ঢাকাতে সাধারণত রাতে বিয়ে হয়। তবে ঢাকার বাহিরে বাহিরের অঞ্চলগুলোতে বিয়ের আয়োজন করা হয় দুপুরে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেই অর্ণ রওনা হয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। যেকোনো মুহূর্তে ক্যাম্পেইনের শিডিউল দিতে পারে। তার ওপর আবার অর্ণ ক্যাপ্টেন।
অর্ণ রওনা হয়েছিল বিকালে। রাত বারোটার মধ্যে তার পৌছে যাবার কথা। বাস ওকে শাহবাগ নামিয়ে দেবে। আর ঢাকা শহরে রাত বারোটা বলতে সন্ধ্যা বোঝায় বৈকি। তবে সময়টা যদি হয় রাত দুইটা, তাহলে সেটাকে রাত হিসেবেই ধরা হয়। শুধু রাত না, গভীর রাত। আর সেদিন তাই ই ছিল অর্ণের ভাগ্যে। অর্ণের গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা আসতে পদ্মা নদী পার হতে হয়। কোনো এক অজানা কারনে সেদিন ফেরিঘাটে অনেক জ্যাম ছিল। আর অজানা কারনের দায়ভার সরকারের উপর চাপাতে আমজনতা মানসিকভাবে সবসময় প্রস্তুত থাকে। তবে দাঁতে দাঁত চাপানো আর নিজের চুলের ফাঁকে হাত দিয়ে চুলকানো ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না অর্ণর। অর্ণ তাই ই করছিল কিছুক্ষণ পর পর। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে যেন সে সকালের মধ্যেই ঢাকা পৌঁছাতে পারে। আল্লাহ ওর কথা শুনেছিলেন। সকাল না, সকালের অনেক আগেই অর্ণ পৌছালো তার গন্তব্যে। রাত দু’টায় বাস এসে থামলো বারডেমের সামনে। ফুল হাতা গেঞ্জি, জিন্স, কনভার্স, কাঁধে ব্যাগ। হাবভাবে অনেকটা আধুনিক। হাজার হলেও ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। তার ওপর আবার ভবিষ্যৎ সাংবাদিক। হাবভাব তো থাকবেই।
এত রাতে গাড়ির চাপ না থাকায় নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হয়ে জাদুঘরের সামনের রাস্তা দিয়ে একাকি আনমনে অর্ণ হেঁটে চলছে ওর হলের দিকে। কানে এয়ারফোন দিয়ে, হাত দু’টো পকেটে রেখে হেঁটে চলছে ফুটপাত ধরে। গান অথবা এফএম শুনছে হয়তো। ফুটপাতটা অনেক স্তব্ধ সেই রাত আড়াইটায়। ব্যস্ত ঢাকা তখন ঘুমোচ্ছে। জাদুঘরের সামনের ফুটপাত তার কত চেনা, প্রায় বিকেলে বন্ধুরা মিলে এখানে ফুচকা খায়। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে সাব্বিরের রং চা ছাড়া তো আড্ডা ই জমে না! সেই সাব্বিরও এখন মনে হয় উচ্চস্বরে নাক ডাকছে। প্রতিদিনই বিকেলে শাহবাগ মোড়ে মনে হয় মেলা বসেছে। এতো মানুষ, আর ফুটপাতে বইয়ের ভ্রাম্যমাণ দোকান, পথচারীদের আনাগোনা – সবই এখন অনুপস্থিত। অর্ণ এসব কথা ভাবছে আর হেঁটে যাচ্ছে ওর হলের দিকে। আজই প্রথম সে এতো রাতে রাতের শাহবাগ দেখছে। অর্ণ নতুনভাবে শাহবাগকে খোঁজার চেষ্টা করছে। আমজনতার সাথে তার ব্যতিক্রমী দিকটা হলো সে অনেক বেশি কৌতূহল প্রিয়। কোনো বিষয় নিয়ে তার জানার আগ্রহ অনেক বেশি।
রাস্তার মাঝে সরকারি হলুদ আলোর আলোতে আবছা আলোকিত রাস্তায় সাব্বিরের চায়ের দোকান পার হতেই অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো এক অপরিচিত কন্ঠস্বর বেশ কয়েকবার ডাক দিলো পিছন থেকে। কানে এয়ারফোন থাকায় অর্ণ ডাকটা বুঝতে পারল না। সেই অপরিচিত কণ্ঠস্বরের স্রষ্টা পেছন থেকে অর্ণকে স্পর্শ করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। অর্ণ কান থেকে এয়ারফোন খুলে তাকাতেই অবাক। বলা যেতে পারে ভয় পেল। চমকালোও বটে! এমনটা সাধারণত হরর মুভিতে দেখা যায়। রাতের আঁধারে হুট করেই একটা অস্তিত্ব চোখের সামনে চলে আসে।
মানুষ কখন অবাক হয়? যখন সে অপরিচিত কোনোকিছুর মুখোমুখি হয়। অর্ণর চমকানোর কারণ সে যেটা আশা করে নি, তখন সে সেই বাস্তবতার মুখোমুখি। ভয়ার্ত কণ্ঠে অর্ণ মানুষটার দিকে তাকাতেই মিষ্টি কণ্ঠে সেই পরিচিত মানুষটা প্রশ্ন করলো – কী হ্যান্ডসাম, একা নাকি?
আপনি? কে আপনি? – অর্ণ ভয় পেল।
ভয় পেয়েছো নাকি? আরে না, আমি ভূত না। বিশ্বাস না হলে গায়ে হাত দিয়ে দেখতে পারো। তবে আমাকে পরী বলতে পারো। – মেয়েটা হেসে হেসে উত্তর দিলো।
কে আপনি? কী চান? – ভয়ার্ত কণ্ঠে অর্ণ আবারো প্রশ্ন করলো। এমন অভিজ্ঞতা তার এই প্রথম।
আমি কিছু চাই না? মানুষ বরং আমার কাছে চায়। আর আমি কে? আমি পরী। – মেয়েটার মুখে রহস্যময় এক হাসি লেগেই আছে।
কৌতূহলী অর্ণ এতক্ষণে বুঝতে সক্ষম হল সে অলৌকিক কিছু দেখছে না। সে বাস্তবতার মুখোমুখি। তাই সে কৌতূহলী হয়ে উঠলো সামনের মানুষটার প্রতি।
আমার অনেক নাম। এক একজন ভালোবেসে এক এক নামে ডাকে। কখনও আমি হই কারও পাখি, কারও ফুল। কখনোবা কারও পরী। আর আমি কারও কাছে কিছু চাই না। মানুষ আমার কাছে চায়। – উত্তর দিলো মেয়েটা।
অর্ণর কৌতূহল বেড়ে গেল। – যেমন ?
এই যেমন আদর, ভালোবাসা, উষ্ণ ছোয়া। – উত্তর দিলো মেয়েটা।
: ওহ, বুঝেছি।
বুঝেছো যখন, তখন চলো। ওহ, আরেকটা কথা। আমি কিন্তু তুমি করে বলবো। আসলে সবাইকে তুমি বলে আদর করি তো তাই। – মেয়েটা কত সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো, যেন সে অর্ণকে কতদিন ধরে চেনে।
বুঝলাম না। – অর্ণর প্রত্যুত্তর।
: ন্যাকা নাকি? গেলে তাড়াতাড়ি চলো। তবে কোথায় যাবে? বাসায় নাকি হোটেলে? আগে থেকেই ঠিক করে যাওয়া ভালো। না হলে পরে ঝামেলা করবা। তোমার মতো পুরুষ মানুষ কত দেখলাম!
আমি আবার আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবো। – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
আশেপাশে ভালো জায়গা আছে নাকি? তোমার মতো একটা ইয়াংস্টার। তোমার তো দেখছি রুচি ভালো না। আরেকটা কথা, চুক্তির টাকা বাদে যাওয়া আসার ভাড়া কিন্তু তুমি দিবে। – নিজের শর্তের কথা বললো মেয়েটা।
: বাসা, হোটেল! বুঝলাম না। আর আমি আপনাকে টাকা দেবো কেনো ?
: আর ঢং করো না তো। আমি কি এতই বোকা? এই মাঝ রাতে তুমি একা ফুটপাতে। মনে হয় কিছু বুঝিনা।
আসলে আমি গ্রামের বাড়ি থেকে এলাম মাত্র। কিছুক্ষণ আগে বাস থেকে নামলাম। এখন হলে যাচ্ছি। – অর্ণ উত্তর দিলো।
হলে! – অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো মেয়েটা।
আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ি। জহুরুল হক হলে থাকি। – উত্তর দিলো অর্ণ।
জীবনে কত হকের সাথেই থাকলাম। ঢং করো না তো। যা করার তাড়াতাড়ি করো। – প্রত্যুত্তর করলো মেয়েটা।
আপনাকে কি কোথাও পৌঁছে দিতে হবে? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
আমাকে আবার কোথায় পৌঁছে দেবে? তুমি যেখানে নিয়ে যাবে, আমি তো সেখানেই যাব। – ভ্রূ নেড়ে, মুচকি হেসে উত্তর দিলো মেয়েটা।
এত রাতে আপনি একটা মেয়ে, এভাবে রাস্তায় একা। ভয় ডর নেই নাকি? – জানতে চাইলো অর্ণ।
ভয়, কিসের ভয় ? – উল্টো প্রশ্ন করলো মেয়েটা।
আমি কিসের কথা বলছি আশা করি বুঝতে পেরেছেন ? – উত্তর দিলো অর্ণ।
আমার মতো যুবতী মেয়েরা সবসময় যে জিনিস হারানোর ভয়ে থাকে আমি সেটা নিয়ে ব্যবসা করি। আমার আবার কিসের ভয়? – কি সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো মেয়েটা।
ব্যবসা করেন? কি করেন আপনি? –
প্রশ্ন করলো অর্ণ।
কাজ করি। না হলে খাব কী? – উত্তর দিলো মেয়েটা।
কী কাজ? – অর্ণ আবারো প্রশ্ন করলো।
সবাই কাজ করে দিনে। আর আমার কাজ রাতে। – উত্তর দিয়েই হো হো হাসিতে ফেটে পড়লো মেয়েটা।
: বুঝলাম না।
: আমার কাজকে তোমাদের শিক্ষিত সমাজ বিভিন্ন উপাধি দিয়েছে। অথচ তারাই কিনা সুযোগ পেলে আমাদের আদর করতে চায়।
: উপাধি? কি উপাধি?
: কলগার্ল চেনো?
: কলগার্ল?
: মনে হয় আকাশ থেকে পড়লে! বোঝ নি? পতিতা চেনো? পতিতা।
what? পতিতা? – মেয়ের সব কথা যেন অর্ণর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
বোকা নাকি? তোমার ই দোষ কী? তোমরা তো বড় বড় ভার্সিটির শিক্ষিত ছাত্র। – উত্তর দিলো মেয়েটা।
: আপনি এভাবে কথা কেনো বলছেন? কী করেন আপনি?
: বাঙ্গালি ছেলে বাংলা বোঝ না? গতর বেঁচে খাই। বুঝেছো? বেশ্যাগিরি করি।
আপনি কী বলতে চেয়েছেন আমি বুঝেছি। তবে আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। – উত্তর দিলো অর্ণ।
: আরে রং ঢং বাদ দাও। আজ একটা কাস্টমারও পেলাম না। কার মুখ দেখে যে উঠেছিলাম, চলো চলো, তাড়াতাড়ি চলো।
: দেখুন, আমি এগুলো পছন্দ করি না।
কেন? পার্মানেন্ট গতর আছে নাকি মাস্তি করার জন্য? – কথাটা শেষ করেই খিল খিল করে হেসে উঠল মেয়েটা।
কী বলতে চাইছেন আপনি? – কিছুটা বিরক্ত হলো অর্ণ।
টাকা পয়সা কম আছে নাকি? আচ্ছা যা মন চায় তাই দিও। আজ একটা কাস্টমারও পেলাম না। সকালে খাওয়ার মতো টাকাও নেই। – উত্তর দিলো মেয়েটা।
: মানে?
: বুঝেছি, আজ আমার কপালটাই খারাপ। ধুর, একটা কাস্টমারও পেলাম না।
: আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। যেতে হবে।
তোমার চেয়ে আমার সময়ের দাম বেশি। তোমার পিছনে আজাইরা সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নাই। – কথাটা শেষ করেই মেয়েটা রওনা শুরু করলো। আর হতভম্ব হয়ে অর্ণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। কোনো এক কারণে মেয়েটা আবার ফিরে আসল অর্ণর কাছে। ভিজিটিং কার্ডের মতো কিছু একটা দিলো অর্ণর হাতে।
কী এটা? – জানতে চাইলো অর্ণ।
: কার্ড।
কিসের কার্ড? – ভ্রূ কুঁচকে অর্ণর কৌতূহল।
: ভিজিটিং কার্ড।
ভিজিটিং কার্ড? – অবাক হল অর্ণ।
অবাক হলে নাকি? কেন? তোমাদের সমাজের সভ্য মানুষের ভিজিটিং কার্ড থাকতে পারলে আমাদের থাকলে দোষ কী? – উত্তর দিলো মেয়েটা।
আপনার কার্ড আমি কী করব? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
উপন্যাস : হলুদ বাতির হাসি
লেখক : শাহরিয়ার সোহাগ
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা, ২০১৬।
এটা লেখকের ৩য় বই।
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ২
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৩
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৪
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৫
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৬
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৭
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৮



No comments