হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ২
এই সমাজে অনেক ভদ্র মানুষ আছে যাদের মানিব্যাগে আমার কার্ড থাকে। মোবাইলে আমার নাম্বার সেভ থাকে। আর তোমাদের মতো ইয়াং পোলাপান তো চিনি। এখন হয়তো ভালো লাগছে না। ক্লান্ত থাকলে এসব কাজ ভালো লাগে না। হঠাত দেখা যাবে এক রাতে ফোন দিয়ে কোনো একটা হোটেলে যেতে বলছো। আসি তাহলে। দেখি কোনো কাস্টমার পাই কিনা। – অর্ণর হাতে ভিজিটিং কার্ড টা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল মেয়েটা।
কথা শেষ করেই মেয়েটা হাঁটা শুরু করলো আজানা উদ্দেশ্যে। অর্ণ মেয়েকে কিছু বলার আগ্রহ নিয়ে পিছন থেকে একবার ডাক দিলেও মেয়েটা খেয়াল করে নি অথবা সেই আওয়াজ মেয়েটার কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি। মুহূর্তেই কোথায় জানি মিলিয়ে গেল মেয়েটা।
ঘড়িতে সময় তখন তিনটার একটু বেশি। এমনিতেই অনেক কষ্টের একটা জার্নি হয়েছে। অনেক ক্লান্ত। ঝিমুনি চোখে কার্ডটা মানিব্যাগে রেখে অতঃপর আবারও হাঁটা শুরু করলো অর্ণ।
রুমে গিয়ে ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে ক্লান্তিভাব কাটিয়ে সকালে ক্যাম্পেইনে যোগ দিলো অর্ণ। ঐ যে, জার্নালিজমের সাতদিনের ক্যাম্পেইন। ক্যাম্পেইন শেষও হলো। এই সাতদিন প্রচন্ড একটা চাপ গেছে অর্ণর ওপর দিয়ে। এতোদিন মানিব্যাগে সেই অপরিচিতার কন্টাক্ট কার্ডটা সেভাবেই ছিল। তবে ব্যস্ততার জন্য তার সম্পর্কে কৌতূহলী হওয়ার সময় পায় নি অর্ণ। ক্যান্টিনে খাবারের বিল দিতে গিয়ে হঠাৎ তার নজর পড়ল সেই কার্ডটার দিকে। রুমে গিয়ে কৌতূহল নিয়ে কার্ডটা বের করলো অর্ণ। কার্ডে যে কি লেখা আছে সেদিন রাতে অর্ণ খেয়ালও করে নি। ‘কলগার্ল হাসি’, নিচে মোবাইল নাম্বার। ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা অর্ধনগ্ন মেয়ের প্রতিচ্ছবি। পূর্ণ কৌতূহলেই সেই হাসি নামের আগন্তুককে ফোন দিলো অর্ণ – হ্যালো, আপনি হাসি বলছে?
: হ্যা হাসি বলছি, কে?
আমি অর্ণ। – নিজের পরিচয় দিলো অর্ণ।
কোন অর্ণ? – প্রশ্ন করলো হাসি ।
ওই যে গত সপ্তাহে রাত আড়াইটায় শাহবাগ ফুটপাতে দেখা হয়েছিল। – কথার মাধ্যমে নিজের মুখটা হাসিকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করলো অর্ণ।
প্রতিদিন তো কারও না কারও সাথে রাত কাটাই। এতোকিছু কি মনে রাখা সম্ভব? – বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো হাসি।
: আমি অর্ণ। ঐ যে রাতে গাড়ি থেকে নেমে জহুরুল হক হলের দিকে যাচ্ছিলাম। পথে আপনার…
: ওহ মনে পড়েছে। এয়ারফোন কানে সেই বেকুবটা। ফোন দিয়েছেন কেন?
: না একচুয়ালি।
: বুঝেছি কেন ফোন দিয়েছেন। পকেটে টাকা হয়েছে তাহলে?
: আসলে তা না। পকেটে কার্ড ছিল। তাই ভাবলাম একটু কথা বলি।
ও মজা নিতে চান? – কিছুটা ক্ষেপে গিয়ে উত্তর দিলো হাসি।
:
আসলে তা না।
তাহলে ফোন দিয়েছেন কেন? – বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো হাসি।
আসলে কৌতূহল থেকেই… –
কথাটা শেষ করতে পারল না অর্ণ।
:
ভাই তার আগে একটা কথা বলি। আমি রাতে কাজ করি। দিনে ঘুমাই। দিনে আসতে বললে আসতে পারব না। কোনো রাতে দরকার পড়লে বলেন, দেখা করব। আমি এখন ঘুমাবো। ওহ, আরেকটা কথা। আসার সময় কিন্তু সঙ্গে টাকা আনবেন। না হলে হাসিকে পাওয়া তো দূরের কথা, হাসির হাসিও দেখতে পারবেন না।
আচ্ছা, তুমি কি প্রতি রাতে ওই ফুটপাতেই থাকো? –
হাসিকে থামাতে অর্ণর প্রশ্ন।
কেন? – পাল্টা প্রশ্ন করলো হাসি ।
: অর্ণ।
: নাহ তোমার বাসায় থাকি।
: বুঝেছি। রাখছি এখন তুমি ঘুমাও।
হুম, ঘুমাবোই তো। না হলে আপনাদের মতো ভদ্র মানুষদের সারারাত আদর কিভাবে করব? – হাসির এই কথাটার মধ্যে একটা চাপা রাগ খুজে পেল অর্ণ।
অর্ণ তার কৌতূহল চেপে রাখতে পারলো না। কৌতূহলী অর্ণ কিছু আবিষ্কারের নেশায় সেদিন মাঝরাতে হাজির হলো সেই ফুটপাতে। অর্ণ হাসিকে আবিষ্কার করলো রাস্তার মাঝের সরকারি হলুদ ল্যাম্পপোস্টের পিলারের নিচে। অপূর্ব দেখতে হাসি মেয়েটা। মানুষ তার স্বাদ নিতে তাকে পরী ডেকে খুশি করলেও সে সত্যিকার অর্থেই একটা পরী। গোলাপি একটা জামা আর লাল পাজামা তার পরনে। ওড়না নেই। পোশাকটা অর্ণর দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতা না পেলেও হাসি এভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে মোহপ্রেমীদের। কাঁধ ছাড়ানো তার চুল। আধুনিকতা আর চাহিদার দিক বিবেচনা করে চুলে হালকা বাদামি রঙ। লাল লিপস্টিক। পায়ে একজোড়া চটি জুতা। বিষণ্ণ চেহারায়, বেমানান পোশাকে, মাঝরাতে সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে তাকে আকর্ষণীয় লাগলেও তার সেই সৌন্দর্য্য যে কারও না কারও দৃষ্টি আকর্ষণের, এটা বুঝতে অর্ণর সময় লাগলো না। হাসির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো অর্ণ।
: জায়গাটা অনেক সুন্দর লাগছে তাই না?
জায়গাটা সুন্দর কি খারাপ তা দিয়ে আমার কী হবে? আমার দরকার কাস্টমার। – অর্ণকে দেখেও না দেখার ভান করে বিষণ্ণভাবে হাসির উত্তর।
কখন এসেছ? – জানতে চাইলো অর্ণ।
অনেকক্ষণ হলো। একটা কাস্টমারও পেলাম না। – হাসির ভারী কণ্ঠে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট।
: চলো, ঐ ছাউনিতে গিয়ে বসি।
বসব মানে? কোথায় যাবে চলো। – উত্তর দিলো হাসি।
আমি আবার কোথায় যাব? – পাল্টা প্রশ্ন করলো অর্ণ।
এটা আমি কী করে বলব? আমাকে তুমি তোমার বাসায় নেবে নাকি হোটেলে নেবে এটা আমি কী করে বলবো? – কাস্টমার পাওয়ায় হাসির চোখেমুখে যেন হাসি ফুটেছে।
তোমার মেকাপ সুন্দর হয়েছে তো !– প্রসঙ্গ এড়াতে হাসির প্রশংসা করলো অর্ণ।
: মেকাপ করে সেজে না থাকলে তোমার মতো পুরুষেরা আমার দিকে তাকাবে নাকি? এখন তাড়াতাড়ি চলো।
আচ্ছা হাসি, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি? – হাসিকে থামালো অর্ণ।
প্রশ্ন করতে সারারাত সময় পাবে। আমি অন্যদের মতো না যে কাজ শেষ করেই চলে যাই। যার সাথে থাকি, সারারাত থাকি। তখন গল্প করবো। এখন চলো। আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব এখানে? – হাসি যেন থামতে চায় না। মনে হচ্ছে কাছের মানুষের কাছে দাবি করছে। এটাই ওদের বৈশিষ্ট্য। খুব দ্রুতই তারা কারও সাথে মিশে যেতে পারে। নিজেকে উজাড় করে দেয়। আর পারিশ্রমিক পাওয়ার পর সেই ভালোবাসার মানুষটাও তাদের কাছে বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।
আচ্ছা হাসি, তোমরা কয় ভাইবোন? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
দেখ, এই দুনিয়ায় আমার সবচেয়ে আপন হলো আমার দেহ। এই দেহের জন্যেই আমি বেঁচে থাকি। এই দেহই আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। – উত্তর দিলো হাসি।
: বুঝলাম না।
একদিনে সব বুঝে ফেললে আমাকে পরে আর খুজবে নাকি? – হেসে উত্তর দিলো হাসি।
আচ্ছা, এতো রাতে এখানে তুমি একা একটা মেয়ে। তোমার ভয় করে না? – আবারো প্রশ্ন করলো অর্ণ।
অন্য মেয়েরা যেটা নিয়ে ভয় পায় আমি সেইটা আরও আকর্ষণীয় করে রাখি। জায়গার জিনিস জায়গায় থাকে। মাঝে এটা ব্যবহার করেই আমি বেঁচে থাকার জন্য টাকা আয় করি। যাদের নিয়ে ভয়, তাদের দিয়েই তো আমার আয়। – উত্তর দিলো হাসি।
তবুও… – কিছুটা দাবি নিয়ে প্রত্যুত্তর করলো অর্ণ।
প্রেমিকা আছে? – দুষ্টুমি হাসিতে প্রশ্ন করলো হাসির।
মাথা নাড়িয়ে না সূচক উত্তর দিলো অর্ণ।
তাহলে কী আমার সাথেই প্রথম বাসর করবা নাকি? – এমন প্রশ্ন করে হাসি নিজেই হাসিতে কুটি কুটি।
অর্ণ কী উত্তর দিবে সেটা বোঝার আগেই আকর্ষণীয় হাসিতে হাসির প্রশ্ন – কী, ভয় পাচ্ছ? নাকি লজ্জা?
: না মানে…
উপন্যাস : হলুদ বাতির হাসি
লেখক : শাহরিয়ার সোহাগ
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা, ২০১৬।
এটা লেখকের ৩য় বই।
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৩
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৪
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৫
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৬
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৭
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৮



No comments