হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৩
আরে সমস্যা নেই। লজ্জা ভাঙিয়ে দেব। জীবনে কত মানুষের লজ্জা ভাঙলাম। প্রথম প্রথম তো লজ্জাতে কাছেই আসে না। আর লজ্জা ভাঙলে তো ছাড়তেই চায় না। তার গতর টিপানোর জন্য আমাকে ভাড়া করে নিয়ে যায়। আর লজ্জা ভেঙে গেলে উল্টো আমার গতর টিপতে থাকে। – হাসি এসব কথা বলছে কি সাবলীল ভাবে!
আচ্ছা, তুমি বলেছিলে তুমি দিনে ঘুমাও, রাতে কাজ করো। তুমি সারারাত জেগে থাকো? – কিছুটা থেমে অর্ণর কৌতূহলী প্রশ্ন।
হুম, কাস্টমার পেলে তো সারারাত জাগতে হয়। অবশ্য না পেলেও সারারাত জাগতে হয় কাস্টমারের আশায়। – উত্তরত দিলো হাসি।
: বুঝলাম না।
তোমাকে বেকুব বলেছিলাম, ঠিকই বলেছিলাম। কাস্টমার না পেলে সারারাত কাস্টমারের আশায় জেগে থাকি? আর কাস্টমার পেলে তো সারারাত নাগরকে আদর করতে হয়। তাহলে রাতে ঘুমাবো কী করে বলো তো। – একটু উচ্চস্বরে কথাগুলো বললো হাসি।
: ও আচ্ছা।
চলো, কোথাও গিয়ে কথা বলি। – মনে হচ্ছে কোনো দাবি নিয়ে বলছে হাসি।
এখন তো ফাস্টফুড, রেস্টুরেন্ট সব বন্ধ। কোথায় বসবো? তাছাড়া জায়গাটা তো সুন্দর লাগছে। – উত্তর দিলো অর্ণ।
পকেটে টাকা নেই? – কিছুটা বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলো হাসি।
: কেন? আছে।
: মনে তো হচ্ছে টাকা নেই। না হলে আমার মতো হাসিকে আদর করতে মানুষ পথ চেয়ে থাকে, তাকে তুমি কাছে পেয়েও আদর করছো না? তোমাকে আমার একটু একটু পছন্দ হয়েছে। আচ্ছা যাও, তোমার জন্য ডিসকাউন্ট আছে।
তোমার সাথে এখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে কী তোমার আপত্তি আছে? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
দেখো, আমি রাতের বেলা কাজ করি। একা দাঁড়িয়ে থাকলে কাস্টমার আসবে। সাথে তুমি থাকলে কেউ আসবে না। আর তুমি তো কোথাও নিচ্ছো না। আমার তো শুধু শুধু সময় নষ্ট হচ্ছে। গতর না বিক্রি করতে পারলে তো টাকা পাব না। তাহলে খাবো কী? – অর্ণকে বোঝানোর চেষ্টা করলো হাসি।
আচ্ছা, আজ তুমি আমার সাথে কথা বলো। আমি তোমার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। আমি তোমাকে আজ রাতের পারিশ্রমিক দিয়ে দেব। তুমি চাইলে আরও বেশি দিব। – হাসিকে অনুরোধ করলো অর্ণ।
হাসিঃ তোমার অনেক টাকা নাকি? টাকার গরম দেখাচ্ছ। দানশীল হতে চাও? তাহলে কোথায় ছিলে তখন, যখন… – থেমে গেল হাসি। তার চোখ দুটো ভিজে এলো।
কখন? – অর্ণের প্রশ্ন।
সেটা তোমার জানার প্রয়োজন নেই। আর শোনো, হাসি দেহ বিক্রি করে খায় তবু কারও দয়া নেয় না। আর এই কাজ করি বাধ্য হয়ে। – কিছুটা ক্ষিপ্র হয়ে উত্তর দিলো হাসি।
তুমি যেটা মিন করছো আমি সেটা বলি নি। মনে করো আজ রাতে আমি তোমাকে কিনে নিলাম। তার বিনিময়ে তোমাকে আমি পারিশ্রমিক দেব। – হাসিকে শান্ত করার চেষ্টা করলো অর্ণ।
আমি কাজ না করে পারিশ্রমিক নেব কেন? আমি আসি। দেখি কোনো কাস্টমার পাই কিনা। – চলে যেতে চাইল হাসি।
সত্যি চলে যাবে? – পথ আটকানোর চেষ্টা করলো অর্ণ।
কেনো রাতে যদি উত্তেজনা থামাতে না পারো, যদি কখনও হাসির হাসি দেখতে মন চায়, তাহলে পকেটে টাকা নিয়ে আমার কাছে এসো। এখন যাও। অর্ণকে চলে যেতে বললো হাসি।
অবস্থা বুঝে চলে যেতে ঘুরে রওনা দিলো অর্ণ।
আর শোন, আমার কাছে ইংরেজি মারাবা না। – পেছন থেকে বললো হাসি।
আচ্ছা, ভালো থেকো তুমি। – হাসির কথার উত্তর দিলো অর্ণ।
আমি তো ভালো থাকতে চাই। পারি কই? – মনে হলো হাসির এই উত্তরের মধ্যে চাপা কষ্ট ভর করে আছে।
তারপর বেশ কিছুদিন অর্ণকে খুব বিষণ্ণ লাগছিল। এক বিকালে অর্ণ একা একা হেঁটে যাচ্ছিল রাতের সেই ফুটপাত ধরে। ব্যস্ত শাহবাগের ফুটপাতগুলোও ব্যস্ত। মানুষগুলো এত ব্যস্ত যে যার মতো হেঁটে চলছে নিজ নিজ গন্তব্যে, বিরতিহীনভাবে।
তবে একসময় রাত নামে। নীরব হয়ে যায় জায়গাটা। আর তখনই সেখানে আগমন ঘটে হাসির। হাসি তার মায়াবি হাসিতে নজর কাড়তে চায় সবার। কখনও পারে, কখনও পারে না। তবুও ক্লান্ত চোখে হাসির মুখে হাসি লেগেই থাকে।
সমাজের সম্পূর্ণ ডিফারেন্ট একটা ক্যারেক্টার। কথিত নিষিদ্ধ একটা পেশা। অথচ এই পেশাই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। কাস্টমার পেলে এক রাতে আয় দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা। একটা মেয়ের সতীত্বের দাম মাত্র পাঁচশ। এর উত্তর হতে পারে– হাসি যে পেশায় নিয়োজিত, সেই পেশার মেয়েদের তো কেউ ইচ্ছা করে সতীত্ব নষ্ট করতে বলে না। মাঝরাতে তো তারাই দাঁড়িয়ে থাকে নির্জন রাস্তায়, নিজেকে অন্যের ব্যবহার্য পণ্য বানানোর জন্য। আচ্ছা, মাত্র দুইশ টাকার জন্য একটা মেয়ে এভাবে নিজেকে নষ্ট করবে? তার পরিবার? তার পরিবার কী কিছুই জানে না? এমন তো নয় যে কেউ তাকে জোর করে ভোগ করছে। তাকে ব্যবহার করে পারিশ্রমিক তো দিচ্ছেই। কেউ আবার হাসির হাসিতে খুশি হয়ে বকশিশও দিচ্ছে। তাদের প্রতি নেই সমাজের কোনো সহানুভূতি নেই। হাসিকে ব্যবহারকারীরা হাসতে হাসতে বলবে– এমন কাজ তাদের নেশা, আর এটাই হলো হাসিদের পেশা। অর্ণ যদি বলে বেঁচে থাকার একমুঠো আশায় হাসি আজ বেছে নিয়েছে এই পেশা, তাহলে কী ভুল হবে? তার এ পেশায় আসা নিয়েও কারও কোনো কৌতূহলই নেই। কৌতূহল কেবল তার পেশা নিয়েণে
অর্ণ হাসির প্রতি কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। তবে সেটাকে অর্ণের দুর্বলতা ভাবলে ভুল হবে। সাংবাদিকদের কাজ হলো লেটেস্ট নতুনত্ব খুজে বের করা। তার ওপর সে কিনা এই পেশার একজন ছাত্র। আগ্রহ কিংবা কৌতূহল তার জন্য অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কৌতূহল নিয়ে আবারও এক রাতে অর্ণ মুখোমুখি হলো হাসির। সময়টা মধ্যরাতে। রাত দেড়টা। ঠান্ডা ঠান্ডা একটা পরিবেশ। হলুদ বাতির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা হাসির দিকে এগিয়ে গেল অর্ণ। ঠান্ডার জন্য শার্টের উপর ব্লেজার পড়েছে অর্ণ। তবে হাসির পোশাকে কোনো পরিবর্তন নেই। পরনে তার সেই একই পোশাক– ওড়নাহীন গোলাপি জামা আর লাল পাজামা। একটা ইয়ং ছেলে হয়েও শীত ধরেছে অর্ণর। তবে মায়াবী হাসির গায়ে নেই কোনো গরম পোশাক। পাশে গিয়ে দাঁড়ালো অর্ণ, হাসি বুঝলো না। কারণ হাসির চোখ তখন রাস্তার দিকে, যদি কোনো কাস্টমার এসে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। অর্ণ অনুধাবন করলো হাসির মলিনতা। গরম পোশাকহীন হাসির গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে আছে হিমবাতাসে। তবুও হাসি নিজের মলিনতা লুকাতে হেসেই চলেছে। কারণ তার হাসিতেই পাগল হবে রাতের পথচারীরা। পরপুরুষকে উষ্ণতা দিতে যে হাসি নিজেকে বিলিয়ে দেয়, সেই হাসির গায়ে এই ঠান্ডায় নেই কোনো উষ্ণ কাপড়।
তুমি কখন এলে? – অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো হাসি।
এইতো এই মাত্র। – উত্তর দিলো অর্ণ ।
টের পেলাম না তো। ভূত হয়ে আসলে নাকি শব্দহীনভাবে? – মুচকি হেসে কথাগুলো বললো হাসি। আজ হাসি রেগে কথা বলল না। আজ হাসির মন ভালো নাকি?
তোমার শীত লাগছে না? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
নাহ! শীত লাগবে কেন? –
সত্য লুকানোর ভঙ্গিতে উত্তর করলো হাসি।
: তুমি কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছো। শীতে তোমার গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।
হ্যাঁ, শীত লাগছে, তাতে তোমার কী? – সত্য লুকাতে না পেরে কিছুটা ধমক দিয়ে উত্তর দিলো হাসি।
: না এমনিতেই বললাম।
: তোমরা তো দিনে কাজ করো। এই শীতের রাতে কম্বলের মধ্যে ঘুমাইলেও ঠিকই তোমাদের খাবার জোগাড় হবে। আমার কাজ তো রাতে। শীত লাগলেও আমাকে ঠিকই আসতে হবে এই ফুটপাতে, মাঝরাতে। আমি দেহ বিক্রি করে খাই। শীতের জন্য সেই দেহ ই যদি ঢেকে রাখি তাহলে রাতের শকুনগুলো আমার দেহ দেখবে কী করে? আর দেহ না দেখালে তো কাস্টমার জুটবে না, খাবারও জোগাড় হবে না।
: আমার ব্লেজারটা তুমি নিতে পারো।
ভিক্ষা দিচ্ছো নাকি? – প্রশ্ন করলো হাসি।
না না, ভিক্ষা বলছো কেন? বলতে পারো আজ রাতে তোমার পারিশ্রমিক। – অর্ণর প্রত্যুত্তর।
: কেন? টাকা নেই নাকি? তুমি টাকা দিলে সেই টাকায় আমার খাবার জোগাড় হবে। টাকা না পেলে খাব কী? আর মরে গেলে এসব জ্যাকেট ফ্যাকেট দিয়ে কী হবে? আমি বাঁচতে চাই।
তুমি কোথায় থাকো? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
এটা জেনে কী করবা? যদি কখনও দরকার হয়, রাতে এখানে আসলেই আমাকে পাবে। – উত্তর দিলো হাসি।
আমি দিনে দিনে তোমার প্রতি আরও বেশি কৌতূহলী হয়ে উঠছি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। – বললো অর্ণ।
তোমার প্রতি আমারও একটু একটু কৌতূহল আছে। ঐ যে সেদিন বললাম না, তোমাকে আমার একটু একটু ভালো লাগে। – একটা অট্ট হাসি হেসে উত্তর দিলো হাসি।
: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতায় পড়ছি।
অর্ণ আরও কিছু বলতে চেয়েছিল। তবে থামিয়ে দিলো হাসি। – থামো, আমার একটা কল আসছে।
অতঃপর হাসি কার সাথে যেন ফোনে কথা বললো। অপরপ্রান্তে কথাগুলো অর্ণ শুনলো না। তবে কিছুক্ষণ পর পর হাসির কণ্ঠস্বর শুনলো। – হ্যালো, হ্যাঁ, ফ্রি আছি। আসতে পারবো। কোথায়? এতো রাতে এত দূর? টাকা কিন্তু বেশি দিতে হবে। বাসা নাকি হোটেল? বউ বেড়াতে গেছে নাকি? টাকা রেডি আছে তো? আচ্ছা আমি আসছি।
তুমি চলে যাবে? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
উপন্যাস : হলুদ বাতির হাসি
লেখক : শাহরিয়ার সোহাগ
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা, ২০১৬।
এটা লেখকের ৩য় বই।
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ২
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৪
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৫
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৬
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৭
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৮



No comments