হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৪
তুমি চলে যাবে? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
: নাহ। তোমার সাথে বসে গান গাইবো। শোন, আমার টাকা দরকার। টাকার জন্য আমি সব করতে পারি। আর তাই হাসি আজ নিজেকে বিক্রি করে জীবন চালায়। কারণ আমি বাঁচতে চাই। হাসি চলে যাচ্ছে। পেছন থেকে অর্ণর জিজ্ঞেস করলো – জ্যাকেটটা?
: আমি ভিক্ষা নেই না। তাছাড়া যেখানে যাচ্ছি সারারাত কম্বলের ভেতরে কাজ করব, শীত করবে না। আর এসব কাজে শীত করে না।
তুমি সত্যিই চলে যাচ্ছো? – হাসিকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করলো অর্ণ।
তাহলে কী বললাম? টাকার জন্য আমি সব করতে পারি। টাকা না পেলে আমি খাব কী? তুমি কী আমাকে খাওয়াবে নাকি? টাকা না পেলে সেন্ট মাখবো কী করে? ঠোঁটে লিপস্টিক, চুলে কালার এসবের টাকা আসবে কোথা থেকে? এসব আসে নিজের দেহ বিক্রি করা টাকা থেকে। তাহলে দেহ বেচবো না কেন বলো তো? – কথাগুলো যেন হাসির চাপা কষ্টের বহিঃপ্রকাশ।
আসবে কখন? – হাসিকে থামাতে অর্ণর প্রশ্ন।
আজ সারারাত ওখানে ডিউটি। বেঁচে থাকলে কাল আবার আসব। নতুন কোনো কাস্টমারের খোঁজে, তার সাথে রাত কাটাবো বলে। আর তুমি বললে তোমার জন্য ডিসকাউন্ট আছে। – একটা হাসি দিয়ে রওনা করলো হাসি।
অর্ণ দাঁড়িয়ে। অর্ণকে পেছনে ফেলে হাসি হেঁটে চলেছে। হাসি হয়তো মুখে হাসি নিয়ে আজ হেঁটে চলেছে নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্যে, কারও বাসায় অথবা হোটেলে। অর্ণ শুধু হাসির অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে হেঁটে যাওয়া দেখছে। এই পথের শেষ কোথায় অর্ণ জানে না। জানে না হাসিও কী তার শেষ পরিণতি। অথবা এর শেষ কোথায়? তবুও সে হেঁটে চলেছে নিশ্চিন্তে। একবার পেছনে ফিরে হাত নেড়ে অর্ণকে বিদায় জানালো হাসি। ওর মুখে তখনও হাসি ছিল। শুধু ছিল না সেই শীতে তার গায়ের সামান্য ওড়নাও। অর্ণও তাকে হাত নেড়ে বিদায় দিলো অনিশ্চিত গন্তব্যে।
কয়েকদিন পর আবারও সেই একই জায়গায় হাজির হলো অর্ণ। তবে হাসিকে পেল না। অর্ণ হঠাত চমকিয়ে গেল। হাসির তো এখানে থাকার কথা ছিল। তাহলে কি…
অর্ণর ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে কিছুদিনের পরিচিত এক কণ্ঠস্বর – আজ দেখছি তুমি আমার আগে এসেছো।
তোমার আজ দেরি হলো যে! – আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো অর্ণ।
তোমার সমস্যাটা কী বলোতো। প্রায় রাতেই তুমি এখানে এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলো। কেন বলো তুমি নিজেও জানো না। তাই বলে তোমার জন্য আমার বসে থাকলে হবে নাকি? তোমার সাথে কথা বললেই কি আমার পেট চলবে? তুমি কি আমাকে খেতে দেবে? নাকি আমার ঘড়ভাড়া দেবে? – বিরক্ত নিয়েই উত্তর দিলো হাসি।
না, মানে। একচুয়ালি… – অর্ণকে থামিয়ে দিলো হাসি। – শোন, তোমাকে না বলেছি আমার সামনে ইংলিশ বলবা না। এমন ইয়েস, নো, থ্যাংক ইউ আমিও বলতে পারি।
: সরি।
হাসিঃ আবারও ইংরেজি। তোমার মতো পুরুষদের তো আমি চিনি। আজ না হোক কাল ঠিকই কোনো একসময় আমার সাথে রাত কাটাবে। আমাকে ভোগ করবে। আমার নরম দেহে হাত বুলাবে। আজ গেলে বল। অন্য কন্ট্রাক্ট ক্যান্সেল করে দিই।
: হাসি আসলে তুমি যা ভাবছো তা নয়। আমি আসলে কৌতূহল থেকে – অর্ণকে আবারও থামিয়ে দিলো হাসি। – বুঝেছি। আজও আমার সময় নষ্ট করেছো। আমি গেলাম। তুমি থাকো তোমার কৌতূহল নিয়ে। তোমার কৌতূহল দেখতে গেলে আমার কাজও হবেনা, খাওয়াও হবে না।
তারপর আবারও হাসির হাসতে হাসতে অনিশ্চিত পথে হেঁটে চলা। অর্ণ সেটার দর্শক মাত্র। হঠাত হাসি দৌড়ে এসে কেন জানি অর্ণকে জড়িয়ে ধরলো। জাপটে ধরলো সজোরে। নিজের অজান্তেই আবেগে অর্ণও জড়িয়ে ধরলো হাসিকে। হাসির চোখে মুখে সেই আকর্ষণীয় হাসি হঠাতই নিখোঁজ। হাসির চোখ ভেজা। হাসির জড়িয়ে ধরার কারণ বোঝা না গেলেও অর্ণর জড়িয়ে ধরা ছিল হাসির প্রতি তার সহানুভূতির প্রকাশ মাত্র।
তোমাকে একটা প্রশ্ন করি? – ভেজা চোখে প্রশ্ন করলো হাসি।
: হ্যাঁ করো।
প্রায় রাতেই তুমি এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করো কেন? – জিজ্ঞেস করলো হাসি।
না মানে। – আমতা আমতা করছে অর্ণ।
তুমি কি আমায় ভালোবাস? – জড়িয়ে ধরে রেখেই প্রশ্ন করলো হাসি।
: না, তা ঠিক নয়। তবে তোমাকে আমার ভালো লাগে।
বেকার না হলে কি বিয়ে করতে? – জিজ্ঞেস করলো হাসি।
: তোমাকে আমার বন্ধু ভাবতে পারি। তোমার বয়স কত?
: বিশ বাইশ হবে।
: আমার বাইশ। তুমি আমার বয়সেরই।
বন্ধু ভাবতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে। – শর্ত জুড়ে দিলো হাসি।
শর্ত? – কৌতূহলী অর্ণর প্রশ্ন।
যখন সেক্স উঠে যাবে তখন কিন্তু আমরা বন্ধু থাকবো না। তখন আমি বেশ্যা আর তুমি খদ্দের। আর কাজ শেষে আমরা আবার বন্ধু হয়ে যাবো। কারণ কাজের সময় বন্ধু ভাবলে আমি তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে পারবো না। – মুহূর্তেই নিজের রূপ বদলে শর্ত বিশ্লেষণ করলো হাসি।
আশা করি এমন কখনও হবে না। – বললো অর্ণ।
বলা যায় না। পুরুষের মন। জীবনে তো আর কম পুরুষের সাথে মিশলাম না। প্রথমে এড়িয়ে চলে। মধুর স্বাদ পেলে সারা দেহ চাটতে থাকে। – – প্রতুত্তর করলো হাসি। কথাটা শেষ করেই একগাল হাসি দিলো সে । এ হাসির হৃদয়ের না, শুধু মুখের।
: আচ্ছা হাসি, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
করো। – নিজেকে লুকিয়ে উত্তর দিলো হাসি।
কিছু মনে করবে না তো? – জানতে চাইলো অর্ণ।
না। বল। – সম্মতি দিলো হাসি।
এই কাজ করতে তোমার খারাপ লাগে না? – প্রশ্ন করলো অর্ণ।
উত্তর দিলো হাসি – খারাপ লাগে। খুব খারাপ লাগে। যখন আমি এক একটা জানোয়ারের সাথে রাত কাটাই, তখন মনে হয় সেটা আমি না, অন্য কেউ। জানোয়ারগুলো যেন জীবনে কখনও মানুষের গন্ধ পায় নি। তাই একটা মেয়ে পেয়ে ওরা যেন ছিঁড়ে খায়। খাবার টাকা জোগাড় করতে আমি ওদের সাথে রাত কাটাই ঠিকই, তবে আমি ঐ পশুদের পশুত্ব সহ্য করতে পারিনা। মাত্র পাঁচশ–একহাজার টাকার বিনিময়ে তারা যেন আমার কাছে শত রাতের মজা নিতে চায়। ইচ্ছে মতো ব্যবহার করে আমাকে। এতে আমি মরি কি বাঁচি তা তারা দেখে না। তবুও আমি এই কাজ করে চলেছি প্রতি রাতে, এক মুঠো বেঁচে থাকার আশায়।
তুমি এই পেশা ছেড়ে দিতে পারো না? – অধিকার নিয়ে অনুরোধ করলো অর্ণ।
আমাকে তুমি পরিচয় দিবে? – পাল্টা অধিকার দেখিয়ে প্রশ্ন করলো হাসি।
সত্যিই তুমি পরিচয় চাও? – আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে প্রত্যুত্তর করলো অর্ণ।
আমার চোখের দিকে তাকাও। তুমি বোঝ না আমার চোখের ভাষা। আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি এসব জানোয়ারগুলোর অত্যাচারে। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই বেঁচে থাকা নয় অর্ণ। আমি প্রকৃত বেঁচে থাকতে চাই। তুমি আমাকে বাঁচাবে? – প্রশ্ন করলো হাসি।
কথাগুলো বলতে বলতে হাসির মুখটা কেমন যেন আরও মলিন হয়ে গেল। তারপর হঠাত অর্ণর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো নিজেই। চোখের পানিগুলো তার সস্তা মেকাপ বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে।
: হাসি, কী হয়েছে তোমার? তুমি কাঁদছ?
উপন্যাস : হলুদ বাতির হাসি
লেখক : শাহরিয়ার সোহাগ
প্রথম প্রকাশ : অমর একুশে বইমেলা, ২০১৬।
এটা লেখকের ৩য় বই।
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ১
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ২
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৩
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৫
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৬
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৭
হলুদ বাতির হাসি || শাহরিয়ার সোহাগ || পর্ব - ৮



No comments